‘কর অব্যবস্থাপনায় বছরে ২ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা হারাচ্ছে সরকার’
কর ফাঁকি আর কর ছাড়ের কারণে বছরে ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে দুই লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
আর ছায়া অর্থনীতির জন্য রাজস্ব হারাচ্ছে বছরে ৮৪ হাজার কোটি টাকা। এ অংক মোট জিডিপির ৩০ শতাংশ। যা দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ৩০০ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব বলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
সোমবার (৩ এপ্রিল) রাজধানীর ধানমন্ডিতে করপোরেট খাতে কর স্বচ্ছতা ও জাতীয় রাজস্ব এবং বাজেটে প্রভাব শীর্ষক ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, একটি যৌক্তিক, স্বচ্ছ ও প্রগতিশীল সুসম কর ব্যবস্থা জাতীয় উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কর ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার আয় করে থাকে। সেই আয়ই জাতীয় বিভিন্ন উন্নয়নে ও সামাজিক উন্নয়নে খরচ হয়ে থাকে। এই কর ব্যবস্থা যতটা আধুনিক হবে কর আহরণ ও তত স্বচ্ছতার সাথে হবে, উন্নয়নের জন্য আমরা তত ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারবো।
তিনি বলেন, আমরা বলে থাকি উন্নয়নে আমাদের বাস্তব জায়গা দরকার। সেই স্পেস তৈরি করতে প্রধান উপায় হলো অভ্যন্তরীণ সম্পদ সঞ্চালন। অভ্যন্তরীণ সম্পদের সঞ্চালনের প্রধান দিক হলো কর্পোরেট ট্যাক্স। এ জন্য কর্পোরেট করের স্বচ্ছতা নিয়ে আলোচনা জরুরি।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গবেষণাপত্র উপস্থাপন করে বলেন, ৬৮ শতাংশ মানুষ করযোগ্য আয় করার পরও আয়কর দেন না। কর জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি না হওয়ার কারণে এটি হচ্ছে। অন্যদিকে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে ২ লাখ ১৩ হাজার কোম্পানি রেজিস্টার্ড হলেও রিটার্ন দাখিল করে মাত্র ৪৫ হাজার কোম্পানি।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আকার ৩০ শতাংশ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে করের পরিমাণ ছিল ২০১০ সালে ২২ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২১ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকা। ছায়া অর্থনীতিতে ৮৪ হাজার কোটি টাকা কর ক্ষতি হচ্ছে। যা জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ। এ টাকা যদি পাওয়া গেলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় তিনগুণ বাড়ানো যেত। অর্থাৎ করনেট বৃদ্ধির প্রতিবদ্ধকতা হচ্ছে প্রধান অপ্রাতিষ্ঠানক খাত। বড় অংশই করের বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে কর ফাঁকি দিন দিন বাড়ছে।
বাংলাদেশের রাজস্ব বোর্ড বলছে ২ লাখ ১৩ হাজার নিবন্ধিত কোম্পানির মধ্যে মাত্র ৪৫ হাজার কর জমা দিচ্ছে। অর্থাত্ নিবন্ধিত ৫টি কোম্পানির একটি কর দিচ্ছে। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত যত বড় তার কর আহরণ তত কম। এরকম একটি হাইপোথিসিস আছে বা এরকম একটি কথা বলা হয়ে থাকে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, কর অসচ্ছতাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। কর ফাঁকি ও কর এড়ানো। কর ফাঁকি দিতে গিয়ে কোম্পানি তার প্রকৃত আয় কম দেখিয়ে থাকে। অন্যদিকে কর এড়ানোর বিষয়টি হলো লিগ্যাল ফ্রেমের আওতায় সরকারের দেওয়া সুবিধা গ্রহণ করে থাকে। আমাদের দৃষ্টিতে এটাও কর অস্বচ্ছতা।
কর ফাঁকি ও কর এড়াতে আর্থিক তথ্য গোপনের প্রবণতা বেড়েছে উল্লেখ করে সিপিডির এই গবেষণা পরিচালক বলেন, বৈশ্বিক ইনডেক্সে কর ফাঁকি ও কর এড়াতে আর্থিক তথ্য গোপন করার প্রবণতায় ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫২তম। বাংলাদেশ ২০২২ সালে আগের বছরের চেয়ে দুই ধাপ পিছিয়েছে। অর্থাৎ দেশে আর্থিক তথ্য গোপন করার প্রবণতা বেড়েছে।
কর ক্ষতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজস্ব কর্মকর্তা ও অডিটরদের সঙ্গে কথা বলে যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে তা হলো, কর ফাঁকি ও কর এড়ানোর মাত্রা ব্যাপক। কেউ কেউ বলছেন, ট্যাক্স লস যেটি হচ্ছে কর এড়ানোর জন্য সেটি ৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। আর কর লস যেটি হচ্ছে কর ফাঁকির জন্য সেটি ১৫ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, কর ফাঁকি যদি ৮০ শতাংশ হয় তাহলে ২ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। কর ফাঁকি ৫০ শতাংশ ধরা হলে রাজস্ব হারানোর পরিমাণ ৪১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে আমাদের ৪১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত কর আদায়ের সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে কর এড়ানোতে যে ব্যয় হচ্ছে সেটা যদি ৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হয় তাহলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪ হাজার কোটি টাকা থেকে ৬৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মত।
কর ছাড়গুলো কিভাবে কমিয়ে আনবেন সেটার একটি লক্ষ্যমাত্রা থাকা দরকার আগামী বাজেটে। কর প্রসাশনের একটি লক্ষমাত্রা থাকা দরকার যে তারা ফাঁকি দেওয়া কর থেকে কিভাবে টাকা উঠিয়ে আনবেন। অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক করা। একটি সমন্বিত লেনদেন কাঠামো দরকার। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ গুলো থেকে বের হয়ে আসতে হবে।