Search

Showing posts with label আমাদের ইশকুল. Show all posts
Showing posts with label আমাদের ইশকুল. Show all posts

Friday, November 14, 2014

বড় লোভ হে...।

‘আমাদের ইশকুল’ গুটিগুটি পায়ে প্রায় পাঁচ বছরে পড়ল। ২০১০ সালের শুরুতে আমি এবং আমার এক বন্ধু, শুরু হয় এই স্কুলের যাত্রা। করতে চেয়েছিলাম বৃদ্ধাশ্রম। করতে না-পেয়ে শুরু করেছিলাম স্কুল। তখন একসঙ্গে তিনটা স্কুলের কাজ চলত। একটা হরিজনপল্লী যেটার চালু নাম মেথরপট্টি সেখানকার শিশুদের জন্য। অন্যটা ছিল চোখে দেখতে পান না সেইসব মানুষদের সন্তানদের জন্য এবং তৃতীয়টা ছিল স্টেশনের শিশুদের জন্য যাদের অধিকাংশই ছিল পিতা-মাতাহীন।

স্কুলগুলো পরিচালনার জন্য অর্থের যোগানের ব্যবস্থা করতেন তিনি মানে আমার বন্ধু আর অন্য সমস্ত কাজ দেখার দায়িত্ব ছিল আমার। এক বছরের মাথায় কোনও প্রকার আগাম সতর্কতা না-দিয়েই তিনি অর্থের যোগান বন্ধ করে দিলেন। হয়তো কোনও প্রকারের সীমাবদ্ধতা হবে কিন্তু আমাকে না-জানানোটা মোটেও ভাল কাজ হয়নি! আমি পড়লাম পানিতে। এখন কী করি, কোথায় যাই কার কাছে যাই? তিন তিনটা স্কুলের তিনজন টিচারের সম্মানী, তিন তিনটা ঘর ভাড়া তো চাট্টিখানি কথা না আমার জন্য। তখন আবার আমার মাথার উপর বিপদ, ভীষণ বিপদ। বহুজাতিক এক কোম্পানির সঙ্গে লড়াই শুরু করেছি মাত্র। অসম এক লড়াই- যেটা কেবল আমার মত বোকা মানুষের পক্ষেই সম্ভব। গুলতি নিয়ে ডায়নোসরের বিরুদ্ধে লড়াই। আসলে আমি ওই বহুজাতিক কোম্পানিকে বোঝতে চেয়েছিলাম, শ্লা, তোমরা ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি না আর আমিও ব্লাডি নেটিভ না। দিস ইজ মাই ল্যান্ড, নো কাউবয় রাইডস হিয়ার।

আমার তখন টাকা-পয়সার বড়ো টানাটানি। কী কষ্টের সেইসব দিন- আহ, একেকটা দিন! এহেন অবস্থায় মাথায় চা চামচের এক চামচ ঘিলু থাকলে আমার যেটা করা প্রয়োজন ছিল সেটা হচ্ছে অতি দ্রুত স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়া। পরিচিত লোকজনেরা জানেন ঘিলু জিনিসটা আমার নাই। তবে যেটা অনেকে জানেন না সেটা হচ্ছে মানুষটা আমি বড়ো ‘জিদ্দি’ টাইপের। আমি হাল ছাড়লাম না। আমার অপার সৌভাগ্য আমার কিছু সুহৃদ বিভিন্ন সময়ে এগিয়ে এসেছিলেন। এঁদের নাম প্রকাশ করলে এঁরা ভারী বিরক্ত হন বিধায় সেপথ মাড়ালাম না। খামাখা পাগল ক্ষেপিয়ে দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ না। আজ এবেলা তাঁদের প্রতি গভীর প্রকাশ করি। পেছনের এই হৃদয়বান মানুষগুলো কেবল ছায়াই হয়ে থাকেন। এ যে অন্যায়, বড়ো অন্যায়!

পরে অবশ্য কৌশল খানিকটা পরিবর্তন করলাম। একেক জায়গার নির্দিষ্ট সময়ে ওখানকার শিশুদেরকে ন্যূনতম শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা। তো, চার নম্বর যে স্কুলটা- যেখানে স্কুলটা চলছিল ওখানকার কাজ শেষ হলো কিন্তু স্কুলটা স্থানান্তর করা যাচ্ছিল না। আমি খুব প্রয়োজন বোধ করছিলাম স্টেশনের কাছাকাছি নতুন স্কুলটা খুলতে কিন্তু জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। রেলওয়ের কতশত জায়গা লোকজনেরা দখল করে রেখেছে অথচ বৈধ কোনও পন্থায় দশ ফিট বাই দশ ফিট একটা ঘরও পাওয়া গেল না!
অবশেষে স্টেশনের কাছে যেটা পাওয়া গেল নড়বড়ে আহামরি কিছু না সেটার জন্য আবার একগাদা টাকা সেলামিও দেওয়া লাগল। তবুও আমার আনন্দের শেষ নেই কারণ ফি-রোজ স্টেশনের চক্কর লাগাবার কারণে আমি এখানকার শিশুদেরকে নিজের হাতের তালুর মত চিনি। কে ড্যান্ডিতে আসক্ত, কার বাপ-মা নেই বিশদ জানার বাকী নেই। এদের সঙ্গে কাজ করাটা যে কতটা জরুরি সেটা বুঝতাম বলেই এখানে স্কুল করার কাতরতা প্রবল ছিল। এখানকার শিশুরা কেউ নিয়মিত ক্লাশ না-করলেও কেবল একদিনের জন্য কাউকে পেলেও কম না। মাথায় যতটা নাড়া দেওয়া যায় আর কী!

কিন্তু শুরুতেই আমি বিপত্তিতে পড়লাম স্কুলের জন্য যে ঘরটা নেওয়া হয়েছিল স্টেশনের শিশুদের জন্য যথেষ্ঠ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু জায়গার টানাটানি! স্টেশনের এই বাচ্চাগুলো পড়তে এতোটা আগ্রহ দেখাবে এটা আমার জন্য অনেকখানি অবাক হওয়ার মত। অবশ্য এখানে এরা যে কেবল পড়তে আসে এমন না, নিয়ম অনুযায়ী পড়ার আগে আধ-ঘন্টা খেলাও।

একজন রাখালবালক থেকে ড. আতিউর রহমান হতে পারলে আমি কেন এই স্বপ্ন দেখব না এই শিশুগুলোর মধ্যে থেকে কেউ একজন বের হয়েআসবে? বড় লোভ হে, বড় লোভ...।

* ’বড় লোভ হে’, কথাটা নাজমুল আলবাবের কাছ থেকে ধার করা। তিনি কোত্থেকে ধার করেছেন এটা আর জিজ্ঞেস করা হয়নি!

Monday, July 28, 2014

খোশ আমদেদ, আপনাদের অপেক্ষায়...।


হাবিজাবি ব্যস্ততার কারণে ক-দিন ধরে স্কুলে যাওয়া হচ্ছিল না। কাল যখন স্কুলের পথে হাঁটা ধরলাম রাস্তায় পুঁচকে একটা শিশু সালাম দিলে বুঝতে পারলাম এ আমাদের ইশকুলের ছাত্র। আমার অতি দুর্বল স্মৃতিশক্তির কারণে এই স্কুলে পড়ছে বা এই স্কুল থেকে বের হয়েছে এমন শিশুদের মুখ আমি মনে রাখতে পারি না। সালাম দিলে আমি চট করে বুঝে যাই এ আমাদের স্কুল নামের কারখানার ছাত্র।

 

শিশুটির সঙ্গে আমার কথোপকথন:

শিশু: তুমরা বলে ইছকুলে সেমাই দিবা?

আমি: কে বলছে তুমারে?

শিশু: কও কী, তুমি জান না!

আমি: নাতো, জানি না তো। আগে কও কে বলছে তুমারে?

শিশু: হগ্গলে কইতাছে।

আমি: হগ্গলে কেডা?

শিশু: ইছকুলের হগল পুলাপাইন। 

 

আমি খানিকটা শঙ্কিত হলাম। শঙ্কিত হওয়ার কারণ আছে। এ সত্য গত বছর আমাদের ইশকুলের সবাইকে সেমাই-টেমাই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার তো এটা সম্ভব না কারণ এই খাতে আমার কাছে বাড়তি কোনও টাকা নাই। আমি মনখারাপ ভাব নিয়ে উল্টো পথে হাঁটা ধরলাম। স্কুলে গেলে বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখিন হব। কী দরকার অহেতুক মনখারাপের পারদ উঁচুতে তুলে।

ফিরে আসতে আসতে চিন্তা করছিলাম কাকে বলা যায়? আমার পরিচিত যারা আছেন তারা বিভিন্ন সময়ে আমার এই সমস্ত অকাজের আবদারে ত্যক্ত হয়ে ভবিষ্যতে আমার মুখদর্শন না-করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

 

কাকে ফাঁদে ফেলা যায় এটা ভেবে-ভেবে সারা। কিন্তু কোনও কূল-কিনারা হয় না! নাকি লটারি করব? রস-কস-শিংগা-বুলবুল-মালেক-মুশতাক... যার নামে শিংগা উঠবে সেই সই? জানি না কেন শেষপর্যন্ত কিছুই করা হয়ে উঠে না। আমার ভেতরের অন্ধকার ঝলমলে দাঁতে বলে উঠে: ওরে, থাকুক না, ঈদের আগে আর স্কুলে না গেলেই তো হবে। ঈদের ক-দিন পর গেলে বাচ্চারা এমনিতেই ভুলে যাবে।

আমিও দেখলাম তাই তো, এ তো মন্দ না।

 

কিন্তু...। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সাজ্জাদ হোসেন নামে একজন ফোন করলেন। তার সঙ্গে আমার কথোপকথন নিম্নরূপ:

সাজ্জাদ হোসেন: ইয়ে, আপনার স্কুলের বাচ্চাদেরকে কাপড় দিতে চাচ্ছিলাম।

আমি: (আনন্দের আতিশয্যে পারলে ফোনেই কিল মেরে বসি। শত-উল্লাস গোপন করে) আরে, তাহলে তো খুব ভাল হয়!

সাজ্জাদ হোসেন: আমি এই অংকের টাকা পাঠাব, কাপড়ের জন্য হবে তো?

(সএসসিতে, আমরা তখন বলতাম মেট্রিক। অংকে আমার ১৩ গ্রেস লেগেছিল অথচ সেই আমিই অতি দ্রুত আঁক কষে ফেলি।)

আমি: এই টাকায় সবার কাপড় তো বেশ হয়ে যাবে। আচ্ছা, সঙ্গে সেমাই দিলে কেমন হয়?

সাজ্জাদ হোসেন: বাহ!

আমি: (হাসি গোপন করে) সেমাইয়ের সঙ্গে চিনিও দিয়ে দেই?

সাজ্জাদ হোসে: কী বলেন, হবে?

আমি: বেশ হবে। আচ্ছা, অল্প কিশমিস না-দিলে কেমন হয় বলুন তো। কিশমিস ছাড়া সেমাই, ধুর! আর শোনেন, দুধ ছাড়া সেমাই রান্না হয় বুঝি! এক প্যাকেট গুঁড়ো দুধও দিয়ে দেই, কি বলেন?

সাজ্জাদ হোসেন: ওয়াল্লা, বলেন কী!

যাই হোক, আজ স্কুলের বাচ্চাদেরকে এইসব দেওয়ার পর্ব শেষ হলো।

স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের মাস্টার-মশাই

 সাজ্জাদ হোসেন নামের মানুষটা আমাকে চমকে দিয়েছেন। কারণটা বলি। এমন না এটাই আমার জীবনের প্রথম ঘটনা। আমার ছোট-ছোট স্বপ্নগুলোর প্রতি বিভিন্ন সময়ে অনেকেই মমতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাহলে?

সাজ্জাদ হোসেন মানুষটা হুজুর টাইপের। এই অল্প বয়সেই ইয়া লম্বা দাড়ি এমনিতে হুজুর টাইপের লোকজনরা অকাতরে মসজিদ-মাদ্রাসায় হস্ত উপুড় করে দেন কিন্তু স্কুলের বেলায় আকাশপানে তাকিয়ে হস্ত গুটিয়ে নেন।

জানি না এরা কেন এমনটা করেন! যারা আক্ষরিক অর্থে অনুসরণ করেন তারা হয়তো বিস্তর ল্যাকাপড়া করে নিশ্চিত হন তৎকালীন সময়ে আরবদেশে স্কুল নামের জিনিস ছিল না। আর তখন ওখানে স্কুলের মত-মত কোনও জিনিস থেকে থাকলেও সেখানে বাংলা পড়ানো হত না।

(তখন কেন বাংলা পড়ানো হতো না এটা আবার দুম করে আমাকে জিজ্ঞেস করে বসবেন না যেন)

 

এই বিষয়ে অতীতে আমার অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত। অসংখ্য ঘটনা থেকে কেবল একটা উল্লেখ করি। হুজুর টাইপের অতি পরিচিত একজন। স্কুলের বাচ্চাদের জন্য তিনি অতি সামান্য সহায়তা দিতে রাজি হননি অথচ তিনি আমাকে বলেছিলেন মসজিদ-মাদ্রাসা করেন পাঁচ-দশ লাখ যা টাকা লাগে দেব। আমি জানি এটা মুখের কথা ছিল না। তিনি সত্যি সত্যিই দিতেন।

 

যেটা বলছিলাম, সাজ্জাদ হোসেনের বিষয়টা তাই আমাকে অনেকখানি বিস্মিত করেছে। কায়মনে আমি চাই এই মানুষগুলোর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাক...অন্তত আমি এঁদের অপেক্ষায় আছি...।   

Monday, December 23, 2013

আমাদের ইশকুল এবং...

আমি যে স্কুলগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলাম যেখানে বাচ্চারা সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা বিনে পয়সায় পড়া-খেলার সুযোগ পেত। সবগুলোর নামই ছিল ‘আমাদের ইশকুল’, এখন যেটা চালু আছে সেটার নামও। তো, এই স্কুলগুলোর স্বপ্নদ্রষ্টাদের একজন, তার নাম এই লেখায় অন্তত উল্লেখ করতে চাচ্ছি না- কেন, সেটার ব্যাখ্য পরে দিচ্ছি। আপাতত নাম তার নাম দিলাম মি, এক্স।

প্রায় ৫ বছর পূর্বে যখন স্কুলগুলো চালু হয় তখন আর্থিক যোগানের ব্যবস্থা করতেন মি. এক্স। দেখভাল, অন্য সমস্ত কাজগুলো করতাম আমি। আমি চেষ্টা করতাম আমার যে অল্প মেধা আছে তার সবটুকু এখানে ঢেলে দিতে।
স্কুল ব্যতীত ‘ন্যানো ক্রেডিট’ এবং আরও অনেক হাবিজাবি কাজও হতো- আমরা ‘পড়শি ফাউন্ডেশন’ নামে একটা প্রতিষ্ঠানও দাঁড় করিয়েছিলাম। যার সদস্য সংখ্যা আমরা দুজনই! মি. এক্স আমাকে বলেছিলেন এটার রেজিস্ট্রেশন করানো প্রয়োজন। রেজিস্ট্রেশন করালে কী লাভ হবে আমি বুঝিনি তবুও আমি বলেছিলাম, আচ্ছা। 

বছর দেড়েক হবে হঠাৎ করে স্কুলের আর্থিক যোগান বন্ধ হয়ে গেল! কেন বন্ধ হলো, সীমাবদ্ধতা কোথায় এই সব আমাকে কিছুই জানালেন না মি. এক্স- জানালে কোনো সমস্যা ছিল না। আক্ষরিক অর্থেই আমি পানিতে পড়লাম। কারণ তখন আমার নিজেরই হাজারোটা সমস্যা- অনেক কটা বছর ধরে একটা বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে আমার আইনি লড়াই চলছিল। কারণটা অতি সহজ। আমি এদেরকে বোঝাবার চেষ্টা করছিলাম, শ্লা, তোমরাও ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি না আর আমি ব্লাডি নেটিভ না।

এ এক বিচিত্র- বছর খানেক কেমন করে এই স্কুল চলল আমি জানি না! কোনো মাসে টিচারের বেতন বাকী থাকত তো কোনো মাসে ঘরভাড়া!  বই-খাতা-খেলার সামগ্রী কিনতে বড়ো বেগ পেতে হতো। আসলে আমি আর পারছিলাম না। এক সময় সিদ্ধান্ত নিলাম স্কুল বন্ধ করে দেব। ডা. গুলজার নামের মানুষটা বললেন, ‘আলী ভাই, বন্ধ করবেন না, দেখি না, চলুক যতদিন চলে...’। তিনি কেমন-কেমন করে কিছু টাকারও ব্যবস্থা করতেন। এভাবে আরও কয়েক মাস স্কুল চলল। কিন্তু দিন-দিন কঠিন হয়ে পড়ছিল। মাস শেষে আমার নিজের সমস্যাগুলোর সঙ্গে যোগ হতো স্কুলের আর্থিক সমস্যা। আমার উপর খুব চাপ পড়ছিল, আমি এই চাপ নিতে পারছিলাম না।

যেখানে গল্প শেষ হয়ে যায় সেখান থেকেই আবারও একটা গল্পের সূত্রপাত হয়। নিকষ অন্ধকার টানেলের শেষ মাথায় আলোর একটা বিন্দু থাকে, থাকতেই হয়। বেশ ক-মাস আগের কথা, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী @Pradip Saha নামের মানুষটা এগিয়ে এলেন। স্কুল চালাবার জন্য তিনি এককালীন এক বছরের টাকা পাঠিয়ে দিলেন। আমি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম! যাক, এক বছরের জন্য নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।

অনেক দিন পর- একদিন, মি. এক্স আমাকে ফোন করলেন, ‘রেজিস্ট্রেশনের কাজ প্রায় শেষ এখন এর সঙ্গে জড়িত লোকজনের নাম প্রয়োজন। আপনার নাম দিতে চাচ্ছি’। পদটা প্রেসিডেন্ট বা চেয়ারম্যান এই টাইপের কিছু হবে, আমার মনে নেই। তার এই কথায় আমি হতভম্ব হয়েছিলাম! এই ফাউন্ডেশন...এই স্কুলটা যাদের জন্য তাদের বিষয়ে বা এই স্কুলটা এতো বছর ধরে কেমন করে চলল এই বিষয়ে তিনি আমাকে একটা প্রশ্ন করলেন না, জানতে চাইলেন না! অথচ...। অদম্য রাগ চেপে আমি বলেছিলাম, ‘আমি চাচ্ছি না আমার নাম এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হোক’। তিনি বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘কেন’? আমি শীতল গলায় বলেছিলাম, ‘এর ব্যাখ্যা দিতে আমি আগ্রহ বোধ করি না’। মি, এক্সের সঙ্গে আলাপচারিতার এখানেই সমাপ্তি...।

লেখার বিষয়ে আমার সাফ কথা, অসঙ্গতি মনে করলে আমি আমার আপন বাপকেও নিয়েও লিখব। তাহলে এখানে মি. এক্সের নামটা কেন দিলাম না? মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার মার শরীরে মি. এক্সের রক্ত মিশে ছিল। কী কষ্ট! আমার মার অপারেশনের সময় রক্তের প্রয়োজন অথচ আমরা ভাই-বোন কেউ রক্ত দিতে পারলাম না কারণ রক্তের গ্রুপ ম্যাচ করছিল না। মি. এক্স রক্ত দিয়েছিলেন। রক্তের ঋণ শোধ করা যায় না কিন্তু অন্তত খানিক চেষ্টা তো করা যায়...।

যাই হোক, ক-দিন পূর্বে ইংল্যান্ড প্রবাসী @Fakruddin Shahariar আমাকে কিছু টাকা পাঠালেন। তাঁর সহৃদয় ইচ্ছা স্কুলের বাচ্চারা একদিন ভাল-মন্দ খাবে। আসলে যারা প্রবাসে থাকেন তাদের ধারণা নেই যে দেশে আমাদের খেতে কতো অল্প টাকা লাগে। খাওয়াপর্ব শেষ হওয়ার পরও তাঁর পাঠানো টাকা থেকে আমার হাতে বেশ কিছু টাকা বেঁচে গেল। আমি পড়লাম মুশকিলে। কী করি এই টাকা দিয়ে?
পূর্বের স্কুলগুলোর বাচ্চাদের জন্য স্কুল-ড্রেস ছিল কিন্তু এখানকার বাচ্চাদের জন্য আর্থিক কারণে সেটা আর সম্ভব হয়নি। অথচ বাচ্চাগুলো প্রায়ই বায়না করত, ‘আমাদের স্কুল ড্রেস দেবেন না’? আমি কষ্ট চেপে বলতাম, ‘দেখি’। আমার এই দেখাদেখির পর্ব আর শেষ হয় না! এবার ঠিক করলাম অনেক হয়েছে- এই দেখাদেখির পর্ব আর না কিন্তু এই বেঁচে যাওয়া টাকার সঙ্গে আরও যে টাকার প্রয়োজন।

মানুষের ইচ্ছা আবার অপূর্ণ থাকে নাকি! সুযোগ একটা এসেই গেল। একজন... জেন্ডার-সংক্রান্ত সমস্যার কারণে তার নামটা এখানে উহ্যই থাক। তিনি বললেন, ‘শুভ, দেশে আসছি’।
আমি বললাম, ‘বেশ তো, অতি আনন্দের বিষয়’।
এরপর তিনি বললেন, ‘শুভ, তোমার বুকের মাপ কত’?
আমি বললাম, ‘তোমার প্লেন ল্যান্ড করার রানওয়ের মত তো না অবশ্যই। কিন্তু ঘটনা কী’!
মানুষটা রেগে গিয়ে বললেন, ‘আমার সঙ্গে শস্তা রসিকতা করবা না। আমি তোমার জন্য একটা ব্লেজার কিনব ঠিক করেছি’।
আমি এবার হাসি চেপে বললাম, ‘দেশে লোকজনেরা শীতবস্ত্র বিতরণ করে ছবি-টবি তোলেন। আমাকেও কী এটা পরে ছবি তোলার জন্য পোজ দিতে হবে’? মানুষটা এবার সত্যি সত্যি ক্ষেপে গেলেন!

শোনো কথা, কে এই মানুষটাকে এই খবরটা দিয়েছে যে, ব্লেজার গায়ে না-দিলে আমার ঘুম আসে না! পূর্বে বিভিন্ন সময়ে যারা এই জিনিসগুলো আমাকে দিয়েছেন ফি বছর নিয়ম করে এগুলো বের করা হয়, শীত গেলে আবার বাক্সে ঢোকানো হয় কিন্তু পরা আর হয় না কারণ এই সব জিনিস পরলে আমার গা কুটকুট করে! ইয়ের পেটে ঘি হজম হয় না টাইপের আর কী!
তো, আমি বললাম, ‘শোনো, এই জিনিস আমার সহ্য হবে না- জিনিসটা আমার কাছে ভারী অকাজের। এক কাজ করো, যে টাকা দিয়ে এই জিনিসটা কিনবে সেই টাকাটা আমাকে পাঠিয়ে দাও। আমার কাজ আছে’।

সূর্যের চেয়ে বালির উত্তাপ বেশি যার নমুনা তিনি দেশে ফেরার পর দেখেছিলাম- সে গল্প থাক। তিনি টাকাটা পাঠাবার পর সব মিলিয়ে বাচ্চাদের স্কুল-ড্রেস হয়ে গেল। অবশ্য 'সেলাই মাস্টার' সাহেব আবার মুখ লম্বা করে রাখতেন কারণ সবগুলো বাচ্চাকে একদিনে কখনই পাওয়া যেত না। বেচারাকে বাচ্চাদের মাপ নেয়ার জন্য কয়েক দিন আসতে হলো। কারণ তিন ভাগের এক ভাগ বাচ্চারাও প্রতিদিন উপস্থিত থাকে না, এদের অনেকেই সারাটা দিন কাগজ-টাগজ টোকায়। যেদিন স্কুলে আসে সেদিন তাদের কাজের সমস্যা হয়।

অনুমতি না-নিয়ে @Pradip Saha এবং @Fakruddin Shahariar নাম এখানে উল্লেখ করেছি বলে মানুষগুলো ভারী রাগ করবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু আমার কিছুই করতে পারবেন না। হা হা হা, কারণ সুদূর প্রবাসে থেকে আমার কেশও স্পর্শ করার ক্ষমতা এঁদের নাই...।

 এদের পতাকা বানাবার চেষ্টা:
   

Sunday, April 10, 2011

হর্ষ-বিষাদ: স্বাধীনতা দিবস

­এবারের স্বাধীনতা দিবসে স্কুল [০] নিয়ে অনুষ্ঠান করার আমার ইচ্ছা ছিল না এটা বলব না কিন্তু অন্য রকম  জটিলতা ছিল। আর্থিক! এই কার্যক্রমগুলোর জন্য যে পড়শী ফাউন্ডেশন থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়া যেত সেটার উৎস বন্ধ! এর দায় আমার উপরই বর্তায় কারণ আমার নিজস্ব ভাবনার কারণে আমি নিজেই এদের কাছ থেকে বিযুক্ত হয়ে গেছি- যুক্ত থাকতে চাইনি।

কিন্তু এবারের স্বাধীনতা দিবসে দুজন ডাক্তার যখন বিনে পয়সায় চিকিৎসাসেবা দেয়ার তীব্র ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন তখন মনে হলো কোন অবস্থাতেই এই সুযোগ হাতছাড়া করা চলে না। দুজন ডাক্তারের মধ্যে একজনের আবার অহেতুক কিছু শর্ত ছিল যেমন তিনি কোন ক্লিনিক, প্যাথলজিতে বসে রোগী দেখবেন না। এখন বাইরে কোথায় রোগি দেখার ব্যবস্থা করি? বাধ্য হয়ে স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে অনুষ্ঠানটার আয়োজন করতেই হলো। আর্থিক সহায়তার জন্য অন্যত্র হাত বাড়াতে হলো। 'রূপালী মেডিকেল' নামের একটি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলো। অবশ্য আগেই এদেরকে এটা বলে নেয়া হয়েছিল এদের সহায়তা নেয়ার কারণে কোন ধরনের বাড়তি সুবিধা দেয়া যাবে না বরং মুক্তিযোদ্ধা এবং অসহায় রোগীর প্রয়োজন হলে এঁরা বিনে পয়সায় টেস্ট করে দেবেন। তাতে এঁরা আপত্তি করেননি। এদেঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা।

কাজে নেমে সে এক হ্যাপা! বাচ্চারা যেখানে বসে ছবি আঁকবে সেখানে ওইসময়ে গনগনে রোদ থাকার কথা। তো, লাগাও সামিয়ানা। বাচ্চাদের পরিবারের লোকজনরা আসবেন এদের জন্য বসার চেয়ার ডেকোরেটর থেকে নিতে হবে। বাড়ছে খরচ। আমার মুখ ক্রমশ অন্ধকার হচ্ছিল। একে তো ফান্ড নেই তার উপর একের-পর-এক খরচ বাড়ছিল।
এবার আবার বাচ্চাদের ছবি আঁকার সঙ্গে যোগ হয়েছিল 'বর্ণ লিখন'। এই আইডিয়াটা আমি পেয়েছিলাম 'কারক নাট্য সম্প্রদায়'[১]-এর কাছ থেকে। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
এবারের অতিথিদের মধ্যে নৌ-কমান্ডো ফজলুল হক ভূঁইয়া [২]-এর সঙ্গে রাখা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা মুখলেছুর রহমান [৩]। যিনি বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। এই মানুষটাকে নিয়ে ডয়চে ভেলে থেকেও প্রতিবেদন এবং রেডিও সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছিল। অবশ্য অসুস্থতার কারণে তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। মন খারাপ হয়েছিল। আহারে, বাচ্চারা তাঁর মুখ থেকে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা জানা থেকে বঞ্চিত হলো।


ছবি ঋণ: বাবু, মিশু, বাবলু



কোত্থেকে খবর পেয়ে জাতীয় দৈনিকগুলোর কয়েকজন স্থানীয় সংবাদদাতারাও চলে এসেছিলেন। এঁদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি কিন্তু ...আমি এঁদের দেখে হাসি গোপন করলাম। আমার হাসির অর্থ আর বলিনি তাহলে সত্য কথাটাই বলতে হতো। আপনারা যে এসেছেন, ভালো কিন্তু আপনাদের পাঠানো নিউজ তো পত্রিকায় ছাপা হবে না- কারণ এই সমস্ত খবর ছাপাবার সময় পত্রিকাওয়ালাদের কোথায়! আপনাদের আবেগ দেখে আগাম হেসে ফেলেছি, এজন্য দুঃখ প্রকাশ করি।

সমস্ত যন্ত্রণার কথা বাদ দিলেও আমার আনন্দের শেষ নেই কারণ আমাকে বলা হয়েছিল এরকম ফ্রি চিকিৎসাসেবায় লোকজনরা তেমন আসেন না। কিন্তু আমার খানিকটা আস্থা ছিল এই জন্য অন্তত স্কুলের বাচ্চাদের পরিবার-পরিজনদের চিকিৎসা করলেও তো একটা কাজের কাজ হয়ে যায়। বাস্তবে তাই হয়েছিল, ডাক্তাররা ৬১জন রোগি দেখেছেন। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে খাটো করি না...।
 

সহায়ক সূত্র:
০.  স্কুল...: http://tinyurl.com/39egrtn
১.  কারক নাট্য সম্প্রদায়: http://www.ali-mahmed.com/2011/03/blog-post_4936.html
২. নৌ-কমান্ডো ফজলুল হক ভূঁইয়া: http://www.ali-mahmed.com/2009/04/blog-post_22.html
৩. মুখলেছুর রহমান: http://www.ali-mahmed.com/2011/03/blog-post_843.html
৪. মুখলেছুর রহমান, ডয়চে ভেলে, প্রতিবেদন: http://www.dw-world.de/dw/article/0,,14898022,00.html
৫. মুখলেছুর রহমান, ডয়চে ভেলে, রেডিও সাক্ষাৎকার: http://bit.ly/fNl6UR

Thursday, December 16, 2010

আমার এক অন্য রকম বিজয় দিবস।

এবারের বিজয় দিবসটা আমার জন্য অনেক অনেকখানি অন্য রকম! গতবার [১] যখন 'আখাউড়া মুক্ত দিবস' নিয়ে অনুষ্ঠানটা করি তখন খানিকটা মন খারাপ ছিল কারণ তিনটা স্কুলের [২] মধ্যে একটা স্কুল বাদ পড়েছিল। এবার আগে থেকেই মন স্থির করে রেখেছিলাম বিজয় দিবস উপলক্ষে ওই স্কুলটাকেও এখানে নিয়ে আসা হবে।
এর মধ্যে একজন দিলেন আবার আরেক পোকা মাথায় ঢুকিয়ে, বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকদেরও নিয়ে আসার জন্য। এই প্রস্তাবটা আমার মনে ধরল। এটা একটা চমৎকার কাজ হবে কারণ আমি নিশ্চিত এই বাচ্চারা যেমন এমন অনুষ্ঠানে পূর্বে কখনও যায়নি তেমনি এদের অভিভাবকরাও।

সকাল ১০টায় যথা সময়ে শুরু হয়ে গেল অনুষ্ঠান। ঠিক সময়ে চলে এসেছেন প্রধান অতিথি নৌ কমান্ডো ফজলুল হক ভূঁইয়া [৩]। আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই এই কারণে তিনি অন্য আমন্ত্রণ ফেলে এখানে চলে এসেছেন, এই অনুষ্ঠানে।

এবারও আঁকার বিষয় ছিল বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সমাধিস্তম্ভের ছবিটা। আমি বারবার এটা বলে যেটা এদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি সেটা হচ্ছে, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠর একজন এখানে। এরা যেন গর্বের সঙ্গে এটা বলতে পারে। আজ যোগ দিয়েছে এদের সঙ্গে এদের কিছু অভিভাবক। অবশ্য অভিভাবকের উপস্থিতি বাচ্চাদের তুলনায় অনেক কম। এতে আমি খুব একটা অবাক হইনি কারণ এই সব খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে অনেক কিছুই অর্থহীন মনে হয়।

কিন্তু আমি এটাও নিশ্চিত, যারা আসেননি তাঁরা খানিকটা আফসোস করবেন। কেন?

হা হা হা, বাচ্চাদের বিভিন্ন পুরস্কারের পাশাপাশি
অভিবাবকদের জন্যও বেশ কিছু উপহার ছিল, তাছাড়া বাচ্চাদের পাশাপাশি অভিভাবকদের উল্লাসেরও কমতি ছিল না। অনুষ্ঠানে দেখলাম এরা বাচ্চাদের চেয়ে কম উপভোগ করেননি। বুকে হাত দিয়ে বলি, সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছি আমি নিজে।
যাই হোক, পরবর্তীতে এটা আশা করতে দোষ কি অভিভাবকদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়বে...।
সহায়ক সূত্র:
১. মুক্ত দিবস...: http://www.ali-mahmed.com/2010/12/blog-post_06.html
২. আমাদের ইশকুল...: http://www.ali-mahmed.com/2010/10/blog-post_07.html
৩. নৌ কমান্ডো...: http://www.ali-mahmed.com/2009/04/blog-post_22.html     

Tuesday, December 7, 2010

স্বপ্নের বীজ!

পূর্বের লেখায় উল্লেখ করেছিলাম [১] তাড়াহুড়োয় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। একটা স্কুলের বাচ্চাদের এই অনুষ্ঠানে আনা সম্ভব হয়নি। আমার মনে হয়েছিল দমে না-গিয়ে দুইটা স্কুল নিয়েই অনুষ্ঠানটা করে ফেলি। প্রধান অতিথির সঙ্গেও তখনও যোগাযোগ হয়নি। তিনি কি এতো স্বল্প সময়ে থাকার জন্য রাজি হবেন? মানুষটাকে ভয়ে ভয়ে দাবী নিয়ে বলি। মানুষটা সহৃদয়। আগের একটা অনুষ্ঠানেও [২] হাতে অল্প সময় নিয়ে বলেছিলাম। তখনও না করেননি, এখনও না!
আঁকার বিষয়বস্তু খানিকটা কঠিন ছিল এদের জন্য। বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সমাধিস্থলের ছবি। কিন্তু...। আমার ইচ্ছা ছিল আঁকার জায়গাটা হবে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সমাধিস্থলে। ঠিক ওখানে বসে আমাদের ইশকুলের [৩] বাচ্চারা সমাধিস্থল দেখে দেখে আঁকার চেষ্টা করবে। কিন্তু সেটা আপাতত সম্ভব হচ্ছে না। নিরুপায় হয়ে রেলস্টেশনের স্কুলে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
ছবি ঋণ: দুলার ঘোষ
ছবি ঋণ: দুলাল ঘোষ
ছবি ঋণ: দুলাল ঘোষ
দুই স্কুল মিলিয়ে পঞ্চাশের উপর বাচ্চারা প্রথম এমন কোন একটা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করল। এই প্রথম আঁকার চেষ্টা করল। সব বীজ থেকে যেমন বৃক্ষ হয় না তেমনি সব বীজই নষ্ট হয়ে যায় এটাও ঠিক না। এখানের বাচ্চারা কেউ-না-কেউ অদেখা স্বপ্ন লালন করবে। এই স্বপ্ন তাকে কেমন করে চালিত করবে এটা সময়ই ঠিক করে দেবে।

সহায়ক লিংক:
১. আখাউড়া মুক্ত দিবস: http://www.ali-mahmed.com/2010/12/blog-post_06.html
২. দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা, স্যালুট ম্যান: http://www.ali-mahmed.com/2010/06/blog-post_4596.html

৩. আমাদের ইশকুল: http://www.ali-mahmed.com/2010/10/blog-post_07.html

Saturday, October 23, 2010

স্কুল, রোবট এবং মানুষের গল্প

আমাদের ইশকুল [১], এই স্কুলগুলোর একটা বিষয়ে আমার তীব্র কষ্ট ছিল! বাচ্চাগুলো ডাক্তার দেখাতে পারছিলাম না! এই বিষয়ে একজন ডাক্তার অনেকখানি সহায়তা করেন কিন্তু তিনি সপ্তাহে একদিনের জন্য ঢাকা থেকে আসেন।
সব মিলিয়ে এখন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১২৫ জন। এদের সবাইকে তো আর নিয়ে এসে দেখানো সম্ভব না। কেবল খুব বেশি অসুস্থ হলে তাঁর কাছে এনে দেখানো হতো।

আমার ইচ্ছা ছিল কোন একজন ডাক্তারকে স্কুলগুলোয় নিয়ে বাচ্চাগুলোকে দেখানো কিন্তু কোন ডাক্তারকে রাজি করানো সম্ভব হয়নি! একজন ডাক্তারকে, কিভাবে স্কুলগুলো চলছে বিতং করে বলা, অনেক তৈলমর্দন, অনেক ধরাধরি করার পরও তিনি একটা স্কুলের জন্য এক হাজার টাকা চাইলেন!
অন্য একজন ডাক্তার। ইনি আবার হুজুর টাইপের মানুষ, গাট্টি-বোঁচকা নিয়ে প্রায়ই ধর্মউদ্ধার করার জন্য বেরিয়ে পড়েন। এই ভদ্রলোককেও স্কুলগুলো সম্বন্ধে বিস্তারিত বলার পর আমি বললাম, আপনি আমাকে কেবল আধ ঘন্টা সময় দেন। আমি আপনাকে নিয়ে যাব, পৌঁছেও দিয়ে যাব। আপনি বাইরে গেলে যে ফি নেন তাও দেব। 
তিনি ঝিম মেরে থেকে বললেন, হুঁ, আপনার কাজ তো ভাল।
আমি মনে মনে বললাম, যাক, আল্লাহ মুখ তুলে চেয়েছেন। এরপর তিনি বললেন, আচ্ছা, আপনি এক সপ্তাহ পরে আসেন।

আমি এইবার চিন্তায় পড়ে গেলাম। ওয়াল্লা, ঘটনা কি? ইনি কি সন্দেহ করছেন আমি সিআইএ-র-মোসাদের এজেন্ট? নাকি এরিমধ্যে খোঁজ-খবর নেবেন, আমি কোন জামা গায়ে দেই; আ মীন, কোন দল করি? কসম, আমি বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেলাম।
গেলাম এক সপ্তাহ পরে। তিনি এবার আমাকে বললেন, সামনে আমার এফসিপিএস পরীক্ষা, এখন তো সময় বের করা মুশকিল।
আমি আবারও কাতর হয়ে বলি, আমাকে কেবল আধ ঘন্টা সময় দেন...। উত্তর নেতিবাচক। আমার ভেতরের তীব্র ক্রোধ পাক খেয়ে উঠে। আমার ভেতরের পশুটার গায়ের তীব্র গন্ধ আমি টের পাই। একে আমি বড়ো ভয় পাই, এ আমার হাতের তালুর মতই চেনা। পূর্বেও আমি এর অনর্থের নমুনা দেখেছি। নিজেকে সামলানো বড়ো কঠিন হয়ে পড়ে। অবশেষে পশুটা লেজ গুটায়, আমি উঠে চলে আসি।
আমি কখন জনান্তিকে এটা বলেছি নিজেও জানি না, তোর এফসিএস পরীক্ষা খারাপ হোক, 'লাড্ডা' মার।

এরা কিন্তু সবাই সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার। আমাদের দেশের এই সব ডাক্তার সাহেবদের পেছনটা কী অপ্রয়োজনীয় ভারী? এরা যে সরকারী মেডিকেল কলেজগুলোতে বছরের-পর-বছর ধরে পাশ দিয়ে ডাক্তার হয়েছেন। যে সরকারী মেডিকেল কলেজগুলোতে বাপের টাকা খরচ করেছেন তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি টাকা খরচ হয়েছে সরকারের। সরকারের এই টাকার যে উৎস তাঁর একটা বড়ো অংশ আসে এই সব হতদরিদ্রদের পরোক্ষ ট্যাক্সের টাকায়।

যাই হোক, আমি বিশ্বাস করি, কোথাও-না-কোথাও প্রাণ বাঁচাবার জন্য একটা গাছ থাকবে, থাকবেই, থাকতেই হবে। এই সেদিন লেখালেখির নামে কী-বোর্ডের উপর অত্যাচার করছি। একটা ফোন আসে, আমি ডাক্তার গুলজার, আপনি কি ওমুক? আমি বলি, হ্যাঁ। ওপাশের মানুষটা এবার বলেন, আমি আপনার সম্বন্ধে... ইত্যাদি ইত্যাদি। দেখা করতে চাচ্ছিলাম।
মানুষটার সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। নজরুল ইসলামের অসুখের বিষয়টি আমি তাঁর কাছ থেকেই জানতে পারি [২]চোখ-কান খোলা একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলেও আরাম। আমার মুগ্ধতা ছাড়িয়ে যায় যখন এই মানুষটাকে স্কুলের বাচ্চাদের দেখে দেয়ার বিষয়ে বলার পর এই মানুষটা একবাক্যে রাজী হয়ে যান। আমি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে থাকি। সময়টা এমন আজকাল নিজেকেও বিশ্বাস করাটা কঠিন হয়ে পড়ে।

কিন্তু আজকের দিনটা আমার জন্য চমৎকার একটা দিন। এই ডাক্তার নামের মানুষটাকে নিয়ে সারাটা দিন পায়ে চাকা লাগিয়ে ঘুরতে থাকি, স্কুল থেকে স্কুলে। সমস্ত বাচ্চাদের প্রথমিক চিকিৎসাটা হয়। অন্তত সবগুলো বাচ্চাকে ক্রিমির ওষুধটা খাওয়ানো গেছে। সরকারের লোকজনরা শুনলে লজ্জা পাবেন, এখানকার অধিকাংশ বাচ্চাই এর পূর্বে আর কখনও ক্রিমির ওষুধ খায়নি, নামই শোনেনি! অবশ্য এটা আমার কথা, স্যারদের কথা না। স্যাররা যখন বলেন তখন তাঁদের কথা বিশ্বাস না করে উপায় কী! এই যেমন, স্বাস্থ্যসচিব হাইকোর্টে হলফনামা দিয়েছেন, এই দেশের সব দম্পতি পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত
ভাল-ভাল। যেদিন (২৭.০৯.১০) এটা পত্রিকায় পড়েছি সেদিন কেবল হাসিই চাপিনি, হাতে-নাতে পরীক্ষাও করেছি। এই নিয়ে হরিজনপল্লীর কয়েকজনের সঙ্গে আলাপও করেছি। আলাপের বিশদে যাই না, কেবল বলি, আমাদের স্বাস্থ্যসচিব সাহেবের মুখের হাসি যে মিলিয়ে যাবে এতে অন্তত আমার কোন সন্দেহ নাই।

স্বাস্থ্যসচিব থাকুন আমাদের স্বাস্থ্য নিয়ে, জটিলসব বিষয়ে মাথা ঘামিয়ে আমাদের লাভ নাই। তো, এই ডাক্তার নামের মানুষটি যে কেবল বিনে পয়সায় তিনটা স্কুলের বাচ্চাদের দেখে দিয়েছেন এটুকুই না, প্রয়োজনীয় ওষুধগুলোও জোগাড় করেছেন!
মানুষটার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা না-করায় কী আসে যায়, এই বাচ্চাদের ব্লেসিং তাঁকে তাড়া করুক, অবিরাম।
অন্ধপল্লীতে: ডা. গুলজার হোসেন
স্টেশনের স্কুলে: ডা. গুলজার হোসেন
হরিজন পল্লীতে: ডা. গুলজান হোসেন
সহায়ক লিংক:
১. আমাদের ইশকুল: http://tinyurl.com/39egrtn
কবি নজরুল: http://www.ali-mahmed.com/2010/10/blog-post_21.html

Thursday, October 7, 2010

'আমাদের ইশকুল' এবং আমার কিছু কথা

আমাদের ইশকুল: ১ [১], যেটা হরিজনদের সন্তানদের নিয়ে, এটা শুরু হয় এ বছরের জুন মাসে। আমাদের ইশকুল: ২ [২], অন্ধদের সন্তানদের জন্যে, এটা চালু হয় এ বছরেরই জুলাইয়ে। আমাদের ইশকুল: ৩ [৩], মূলত মৌলিক সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্যে, যাদের অধিকাংশদেরই বাবা-মা-স্বজন নেই, এরা পানি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে এবং ঘুমায় স্টেশনের ওভারব্রীজে। এটা আরম্ভ হয় গত মাসে।
এই স্কুলটা করার কথা আমি আমার নিজের সাইটে লিখেছিলাম, "পারলে আমি আগামীকালই চালু করে দেই। কে দেখেছে সামার, কে দেখেছে শীত"?
এটা একরকম পাগলামি ছিল কারণ তখন পর্যন্ত স্কুলঘরের পাত্তা নেই, টিচারের পাত্তা নেই। আমি জানি না কেমন কেমন করে পরদিনই স্কুলটা চালু করা সম্ভব হয়েছিল!

আমি খুবই সৌভাগ্যবান, জানি না কেমন কেমন করে তিনটা স্কুলই দাঁড়িয়ে গেল! লাক? হতে পারে! কিন্তু অনেকের অযাচিত সহায়তা পেয়েছি যার বর্ণনা শুরু করলে আস্ত একটা উপন্যাস হয়ে যাবে! কার কথা ছেড়ে কার কথা বলব?

সম্প্রতি 'আমাদের ইশকুল' নিয়ে ডয়চে ভেলে একটা রেডিও অনুষ্ঠান করেছে [৪]। ডয়চে ভেলের তাদের সাইটে প্রতিবেদনও ছাপিয়েছে [৫]। আমাদের দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমেও কিছু প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে [৬], [৭], [৮], [৯]
ওখানে আমি বলেছিলাম, "আমি কেবল অক্ষর শেখাবার উপরই জোর দিচ্ছি না। একটা শিশুর শেখার জন্য যা যা প্রয়োজন। হাতের নোখ ছোট কি না, খাওয়ার আগে হাত ধুচ্ছে কি না। কলাটা কেমন করে খাচ্ছে"?
আমি কিছু বয়স্ক মানুষদেরকেও দেখেছি, কলার খোসাটা সবটা ছাড়িয়ে কলাটা হাতে ধরে অবিকল বাঁদরের মত খেতে! তো, শিশুটি কলাটা খাচ্ছে কেমন করে? মনে করে কলার খোসাটা আবর্জনার বাক্সে ফেলছে কি না? এরপর সমস্ত খোসা জমিয়ে ছাগলকে দিচ্ছে কি না। তাকে এটাও শেখাবার চেষ্টা করা তার জন্য যেমন কলাটা প্রয়োজন তেমনি ছাগলের জন্য খোসা।

যাই হোক, মিডিয়ায় স্কুলের প্রসঙ্গ আসাটা অত্যন্ত আনন্দিত হওয়ার মত বিষয় কিন্তু আমি বেশ খানিকটা বিব্রত বোধও করছি। কারণ সব ছাপিয়ে কেবল আমার নাম চলে আসছে। এ অন্যায়! সত্যি বলতে কি এখানে আমার ভূমিকা গৌণ- আমি কেবল এই সব শিশুদের স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করছি। ব্যস, এই-ই। আমার কাজ এটুকুই। তবে এও সত্য, আমি আমার অর্জিত অতি সামান্য মননের পুরোটাই কাজে লাগাবার চেষ্টা করছি।
আর স্বার্থপরের মত নিজে যে স্বপ্নটা দেখছি, রাখালবালক থেকে একজন ড. আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হতে পারলে এদের কেউ পারবে না কেন, কে এই মাথার দিব্যি দিয়েছে?

আমি কেমন করে বিস্মৃত হই, আমার এই স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের পেছনে সাদিক আলমের অবদানের কথা। যে 'পড়শী ফাউন্ডেশন' আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে, এবং পড়শী ফাউন্ডেশনে যারা আর্থিক যোগান দিয়েছেন তাঁদের কথা। এই মানুষগুলোর অধিকাংশই কী নির্মোহ, এঁরা তাঁদের নাম কোথাও আসুক এটা পর্যন্ত চাননি! আর আমার স্ত্রী, যে দিনের-পর-দিন মুচির মেয়েদেরকে পড়াচ্ছে তার কথাই বা কেমন করে ভুলে যাব?

ভাল কথা, চর্মকার-মুচির সন্তানদের নিয়ে পরবর্তী স্কুল করার ভাবনাটা মাথায় আছে আমার। এবং বেদেদের সন্তানদের নিয়েও একটা স্কুল চালু করার।
বেদে নামের এই রহস্যময় মানুষদের নিয়ে আমার আগ্রহ সীমাহীন।
এঁদের বিষয়ে জানতে আমি আগ্রহী। আমার সংগ্রহশালার জন্যে একটা বীনও (সঠিক নামটা আমি জানি না, যেটা বাজিয়ে সাপের খেলা দেখানো হয়) প্রয়োজন। এটা সংগ্রহ করার শখ আমার অনেকদিনের।
কালই এক বেদে বহরের খোঁজ পেয়েছিলাম। এরা নাকি গঙ্গাসাগর নামের একটা জায়গায় আস্তানা গেড়েছে। কিন্তু গিয়ে হতাশ হলাম কারণ এখানে সাকুল্যে চারটা পরিবার থাকে তাও এরা মাসখানেকের মধ্যে এখান থেকে সরে পড়বে। এমনিতে এরা সাপ ধরে না, সাপের খেলাও দেখায় না, নৌকায়ও বসবাস করে না। ডাঙ্গায় ছাপড়ার মত ঘর উঠিয়ে থাকে।

এমন না বাস্তবতা আমি বুঝি না, আমি চাইলেই নতুন স্কুল খুলতে পারব না- আমাকেও কিছু জবাবদিহিতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এভাবে কাজ করে আমি আরাম পাই না। আমার মধ্যে সমস্যা আছে, আমি কোন চাপে থেকে কাজ করতে পারি না। আমি আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে কাজ করতে পছন্দ করি। এটা কারও ভাল লাগুক বা না-লাগুক এতে আমার অহেতুক কাতরতা নাই।
যে তিনটা স্কুল এখন চলছে এটা কতদিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলবে আমি জানি না। আমি শিউরে উঠি এটা ভেবে, কখনও যদি স্কুলগুলো বন্ধ করে দিতে হয়...। এসবের মধ্যে নতুন স্কুল করার কথা ভাবাটাও বোকামি।
কিন্তু আমি ভাবব, এমন বোকামি করব, বারবার করব। চালু করব মুচিদের সন্তানদের নিয়ে এবং বেদেদের সন্তানদের জন্যে স্কুল।
পুরনো কথাটাই আবারও বলি, কে দেখেছে সামার...?

সহায়ক লিংক:
১. আমাদের ইশকুল, এক: http://tinyurl.com/3xpuov5
২. আমাদের ইশকুল, দুই: http://tinyurl.com/2fs9j4p
৩. আমাদের ইশকুল, তিন: http://tinyurl.com/327aky3
৪. ডয়চে ভেলের রেডিও অনুষ্ঠান: http://tinyurl.com/2umlksm
৫. ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন: http://www.dw-world.de/dw/article/0,,6087822,00.html
৬. কালের কন্ঠ, ১: http://tinyurl.com/3a5ckr4
৭. কালের কন্ঠ, ২: http://tinyurl.com/33mdvw9
৮. আমার দেশ, ১: http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/07/31/36761
৯. আমার দেশ, ২: http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/08/22/40362
১০. পড়শী ফাউন্ডেশন, সাদিক আলমের ব্লগ: http://www.mysticsaint.info/p/sacred-activism.html