গল্প

গন্তব্যের শ্রান্তি

মো. রিজওয়ানুল ইসলাম

আলতাফনগর স্টেশনের স্টেশন মাস্টারের জরাজীর্ণ ঘড়িটা এক এক করে নয়বার ঢঙ ঢঙ করে বেজে থেমে গেল। রাত আটটার ট্রেনটা প্রতি দিনের অনিয়মের নিয়ম মেনে অল্পক্ষণ আগে স্টেশনে এসে পৌঁছলো। ফাহিম স্টেশন থেকে নেমে পাকা রাস্তা ধরে হন হন করে এগুতে লাগলো। এদিকে সন্ধ্যায় এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে, সাথে সাথেই বিদ্যুৎ চলে গেছে, দোকানপাট তাই খুব একটা খোলা নেই। বাজারের সবচেয়ে বড় রেস্টুরেন্টটাতে গিয়ে ও ঢুকলো। রেস্টুরেন্টটা প্রায় ফাঁকা, সে সামনের একটা টেবিল দখল করে বসলো। তার কাপড়-চোপড় বেশভূষা দেখে শহরের খদ্দের মনে করে রেস্টুরেন্ট মালিক মকবুল সাহেব  ভালো কিছু বিক্রির আশায় আশান্বিত হলেন। আশার সাথে অবশ্য তাঁর কৌতুহলও বাদ গেল না। রাতের ট্রেন থেকে যারা নামে, তারা সবাইই সাধারণত তাঁর চেনা লোক। এই অজপাড়া গ্রামে রাত বিরাতে বাইরের মানুষ কেই বা আসবে? রাতের ট্রেনে এই  স্টেশনে নামা যাত্রীরা কেউ গ্রামের হাট-বাজার থেকে পণ্য নিয়ে শহরে বিক্রি করে ফিরেন, আবার কেউ শহর থেকে বিভিন্ন কল-কারখানা, অফিস-আদালতে কাজ করে বা রিক্সা চালিয়ে রাতে গ্রামে ফিরে্ন। এই  মানুষদের শহরে কাজ আছে, কিন্তু রাতে থাকবার মত কোন ঠাঁই নেই। ফাহিমকে তার একটু চেনাচেনা মনে হলেও তিনি ঠিক চিনতে পারেন না। ওকে আদৌ কিছু জিজ্ঞেস করবেন কিনা তাও তিনি বুঝতে পারছিলেন না। দিনকাল বড় খারাপ, কার মনের ভিতরে কি আছে কে জানে। আর আজকাল আগের জমানার মানুষের মত ইয়াং ছেলে-মেয়েরা মুরব্বিদেরকে সম্মানও করে না। তাই কি প্রশ্ন করলে কি হবে, এই ভেবে তিনি তাঁর উদ্ধত কৌতূহলটাকে দমিয়ে রাখলেন। হোটেলের প্রায় সবাই সারাদিনের এঁটো বাসন-কোসন ধুতে ব্যস্ত। কে এল, কে গেল - এ নিয়ে তাদের ভাবনা নেই।

কাস্টমার চলে এসেছে, কিন্তু কেউ তার কাছে গিয়ে তার অর্ডারটা নিচ্ছে না দেখে মকবুল সাহেবের মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল। তিনি অশ্রাব্য একটা খিস্তি দিয়ে একজন বয়কে ডাকলেন। বয়টার বয়স ১০-১২ বছরের বেশি হবে না। তার পরনে ছেঁড়া কাপড়-চোপড়। যেন তাকে খুব মধুর কোন কথা বলা হয়েছে তাই সে খুব আনন্দ নিয়ে হাসি মুখে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কি কন স্যার?’ বয় প্রতিদিন খিস্তি শুনে অভ্যস্ত, খিস্তি না শুনলেই যেন তার কিছু ভালো লাগে না, কোথায় কি একটা বাদ থেকে যায়। 

-‘স্যার কি চায়, দ্যাখ হারামজাদা’

‘কি দিমু স্যার?’ আগের মতোই হাসি মুখে ফাহিমকে জিজ্ঞেস করে ছেলেটি। 

- ‘শুধু চা, আর কিছু না। চায়ে আদা-লেবু দিলে ভালো হয়।’

ফাহিমের এই শুকনো উত্তর শুনে মকবুল সাহেবের আশান্বিত চোখের আলোটা দপ করে নিভে যায়। এমনিতেই সারাদিন তেমন একটা বেচা বিক্রি হয়নি, ঝুম বৃষ্টিতে কেইবা আসবে বাজারে আর আসলেও তাড়াহুড়ো করে বাজার করে সেও গ্রামে ফিরে যাবে, রেস্টুরেন্টে বসে রাজা-উজির মারার মত ফুসরত কোথায়? হতাশ মকবুল সাহেব ক্যাশ বাক্স খুলে টাকা গুণতে শুরু করেন। 

আদা আর লেবু দিয়ে বানানো চা ফাহিমের বেশ মজাই লাগে। ফাহিম চা শেষ করেই রাস্তায় নেমে দেখে আকাশের অবস্থা বেশ সঙ্গীন। আকাশে কোথাও কোন তারার অস্তিত্ব নেই। বৃষ্টি নামবে নামবে করেও নামছে না। সে স্টেশনের থেকে দক্ষিণের মাটির রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে এগুতে থাকে। রাস্তায এঁটেল মাটির থকথকে কাদা। সে তার কেডস জোড়াটা খুলে ব্যাগে রাখলো। এই কেডস পড়ে খেলাধুলা করা যেতে পারে, কিন্তু এঁটেল মাটির রাস্তায় হাঁটা সম্ভব নয়। সে তার জিন্সের প্যান্টটাও গুটিয়ে ফেলল। আকাশে কালো মেঘের জন্য রাস্তাটাও সে ভালমতো দেখতে পাচ্ছে না। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানিতে শুধু যেন রাস্তাটা এক ঝলক দেখা যাচ্ছে। রাস্তায় একটা মানুষও নেই। ফাহিম যেন কোন অন্ধকারপুরীতে হাঁটছে। রাত মাত্র সাড়ে নয়টার মত বাজে, কিন্তু গ্রামের মানুষদের প্রায় সবারই এক চমক ঘুম হয়ে গিয়েছে।

এই এলাকায় স্টেশনে বিদ্যুৎ থাকলেও ফাহিমদের গ্রামে বা আশেপাশের গ্রামে বিদ্যুতের কোন বালাই নেই। মানুষ ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠেন, আর সাড়ে নয়টা বর্ষার রাতে তেমন কোন রাত না হলেও গ্রামের জন্য অনেক রাত। ঔষধ যেমন শুধু শরীরকে সুস্থ রাখে, রসনা মেটায় না, সন্ধ্যার বৃষ্টিও গ্রামের মানুষকে শুধু ঘুম পাড়ায়, ভাবালু করে না। দিনভর মাঠে, বাজারে পরিশ্রমের পর তারা অনেক দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়েন। হয়তো শুধু দুই-চারজন বৃদ্ধ বা যুবক বা শিক্ষার্থী ভয়েস অব আমেরিকা বা বিবিসি রেডিওতে খবর শোনেন। রাতের অন্ধকারে গ্রামের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে তাদের রেডিওর শব্দ বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। এর বাইরে এই রাতে বসে বসে, জেগে ভার-বিলাসের ফুসরত কারই বা গ্রামে রয়েছে। 

হঠাৎ করেই কাল বিকেলে ফাহিমের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এরশাদ সাহেবের জাতীয় পার্টি নির্বাচনে বিপুল বিজয়ী হয়েছেন। তার দল আসন পেয়েছে ২৫১টি। সম্মিলিত বিরোধী দল, বাকি সব দল, এবং স্বতন্ত্র মিলিয়ে মাত্র ৪৯টি আসন পেয়েছে। ভোটও পড়েছে পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি এবং এরশাদ সাহেব বিরোধী দলের হুমকি-ধামকি উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেয়ায় জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিন্তু তারপরও বেয়াড়া ছাত্রদের প্রতিবাদ থেমে থাকে নি। এরশাদ সাহেব তাই ভেবেছেন, ছাত্ররা ছাড়া ঘরের খেয়ে বনের মোষ আর কেইবা তাড়াবে? যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আর কিসের আন্দোলন? তিনি তাই হঠাৎ করেই সকাল বেলা প্রেসনোট জারি করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সন্ধ্যার মধ্যে সব হল খালি করার জন্য বলে দিয়েছেন। ফাহিম তারপরও ভাবছিলো সে হয়তো বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই তার বন্ধু আহমেদের বাসার চিলেকোঠায় থেকে হলেও শহরেই থেকে যাবে। কারণ একবার যদি সে গ্রামে চলে যায় হয়তো সে তার টিউশনিগুলো ফিরে পাবেনা, কিন্তু সে সময়ে হঠাৎ করে তার নামে রেজিস্টার্ড ডাকে একটা চিঠি আসে। চিঠিটা লিখেছে তার মামাতো বোন ফরিদা। খুব অল্প কথার চিঠি। খুব সাদামাটা, কিন্তু ভয়াবহ একটা  প্রেমপত্র। ফাহিম জানতোও না ফরিদা কবেই বা এত বড় হয়েছে।

ফরিদার বাবা তাদের কলেজে নতুন জয়েন করা এক ইংরেজির প্রভাষকের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছেন। শুধু ইংরেজির প্রভাষকই নয়, তার বাবা আবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও বটে। কিন্তু ফরিদা কোন অবস্থাতেই সে বিয়েতে রাজি না। ফরিদা বেশ গুছিয়ে লিখেছে, ফাহিম যদি গিয়ে দ্রুত এই বিয়ে বন্ধ করে তাকে বিয়ের ব্যাপারে আয়োজন করতে না পারে, তাহলে সে খুব ভয়ঙ্কর কিছু করে ফেলবে। চিঠিটা পড়েই ফাহিমের গা-হাত-পা কেঁপে ওঠেছিল। তার সাথে ফরিদা অনেক খুনসুটি করলেও প্রেম বলতে যা বুঝায় তা কখনই তাদের মধ্যে ছিল না। সে কখনও বুঝে ওঠতে পারেনি ফরিদা তাকে কোন বিশেষ চোখে দেখে। এই তো সেই ফরিদা যার সাথে সে ছোট বেলা থেকে মামার বাড়িতে খেলেছে। ফাহিমের ছোটবেলা থেকেই মা-বাবা নেই। তার বাবা মারা গিয়েছেন তার জন্মের পরপরই, তার মাও তাকে ছোট রেখেই মারা গিয়েছেন। সে মামা বাড়িতেই মানুষ। মামা মামীও তাকে খুব স্নেহ করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে তার মামাকে প্রচন্ড ভয় পায়, সে তো চিন্তাই করতে পারছেনা কিভাবে তার মামাকে গিয়ে ফরিদার বিয়ে বন্ধ করার জন্য বলবে। সে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার জন্য তখনই গ্রামে না এসে তার বন্ধুর সাথে একদিন থেকেছে। তারপর বন্ধুর পরামর্শে অনেক চিন্তা করে সে ভেবেছে, আর যাই হোক যেহেতু ফরিদা এরকম করে তাকে লিখেছে তাকে তো একটা কিছু বিহিত করতেই হবে; নাহলে যদি ফরিদা সত্যিই কোনো নাটক করে ফেলে তাহলে কি হবে? সে ভেবেছে মামাকে কিছু না বলতে পারলেও অন্তত মামীকে গিয়ে সে একটা কিছু বলবে। কি বলবে, কিভাবে বলবে সে জানে না; কিন্তু সে জানে তাকে কিছু বলতেই হবে, তাকে কিছু করতেই হবে।  এদিকে তার মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার ডেট একের পর এক শুধু পিছিয়েই গিয়েছে। বিসিএসেরও তেমন কোনো খবর নেই, সে কবে প্রিলিমিনারিতে টিকেছে, তার রিটেন পরীক্ষাও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার রেজাল্টেরও কোন খবর নেই, ভাইভার ডেটের তো প্রশ্নই আসে না। এই অবস্থায় সে সরাসরি বিয়ের কথা বা বলেই কোন মুখে। যাহোক তাকে একটা কিছু করতেই হবে এই ভাবনা করেই সে পরের দিনই গ্রামে রওনা হয়েছে। 

স্টেশন থেকে ফাহিমের গ্রামের দূরত্ব বর্ষায় বেড়ে যায়, আর শীতকালে কমে যায়। শীতে হনহন করে হেঁটে যেখানে পঞ্চাশ মিনিট থেকে এক ঘন্টায় গ্রামে চলে যাওয়া যায়, বর্ষায় যেন সে রাস্তা হয়ে ওঠে অনেক বেশি দূর। ফাহিম বেশ কায়দা করে তার পকেট থেকে একটা ক্যাপস্টেন সিগারেট বের করে। বাতাসটা একটু ধরে এসেছে বলে সিগারেট ধরাতে তার অবশ্য তেমন একটা কষ্ট হয় না। আস্তে আস্তে সে হাঁটতে থাকে, এদিকে হঠাৎ করে আবার একটু বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। ফাহিম প্রথমে একটু গা বাঁচানোর চেষ্টা করে। সে তার ব্যাগ থেকে একটা কাপড় বের করে মাথায় দেয়। কিন্তু একটু পরেই সে বুঝতে পারে এই বৃষ্টিতে তার কাপড় কোন কাজে আসবে না। সে তাই কাপড়টা আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে বৃষ্টিতে ভেজাটাই উপভোগ করতে চেষ্টা করে। 

ফাহিম বেশ সন্তর্পনেই হাঁটার চেষ্টা করছে তবুও কিছুক্ষণ পরে অন্যমনস্কভাবে সে হঠাৎ করে কাদায় পিছলে পড়ে যায়। সে তেমন একটা ব্যথা না পেলেও একটু বিব্রত হয়। তবে এটা ভেবে স্বস্তি পায় যে রাতের এই জন মানুষহীন রাস্তায় তাকে কেউ দেখবে না। প্রায় মাইলখানেক রাস্তা হাঁটার পরে সে একটা জঙ্গলের কাছে আসে। জঙ্গল বলতে রাস্তার পাশে বেশ অনেকগুলো গাছের সমারোহ আর একটা উঁচু টিলা। গ্রামের মানুষজন এটাকে গড় বলে থাকেন। অনেকে বলেন, মাঝে মাঝে এখানে পরী দেখা যায়। কেউ কেউ অতিকায় ভূত দেখেছেন, এমনও বলে থাকেন। ফাহিম ভূতপ্রেত একদমই বিশ্বাস করে না। সে এগুলো নিয়ে তেমন কখনো ভাবেও নি। তবুও আজকে এই অন্ধকারের রাস্তায় কেমন জানি তার গাটা একটু ছমছম করে ওঠে। তার মনে একটু করে ডাকাতের শঙ্কাও চলে আসে। এইতো গত ঈদের সময় সে মামার কাছে শুনেছিল আগের মত না হলেও এখনো মাঝে মাঝে এখানে রাতে ডাকাতি হয়। আর ডাকাতরা যদি পথচারীর কাছে কিছু না পায়, তাহলে অনেক সময় তার পেটে চাকু চালিয়ে দেয়। আশেপাশের বেশ কিছু দূরে এর মধ্যে কোন লোকালয় নেই, তাই পথচারীর আর্ত চিৎকারেও কারও এগিয়ে আসার কোন সম্ভাবনা নেই।

ফাহিম খুব একটা ধর্মপ্রাণ ছেলে নয়। সে জুমার নামাজ পড়ে বটে,  কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ তার প্রায়ই পড়া হয় না। কিন্তু সে এবার আয়াতুল কুরসি পড়ে তার বুকে ফুঁ দেয়। তার মনে পড়ে খুব ছোট বেলায় মা তাকে আয়াতুল কুরসি শিখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কখনো ভয় পেলে আয়াতুল কুরসি পড়তে, তাহলে ফেরেশতারা তাকে পাহারা দিবে। আয়াতুল কুরসি পড়ে তার মনে একটু স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করলেও কোথায় যেন একটা অস্বস্তি থেকেই যায়। ফাহিম একবার রাস্তার দিকে চোখ দেয়ার চেষ্টা করে আরেকবার সে জঙ্গলের দিকে তাকায়। কে জানে, শুধু তো জ্বীন-পরী নয়, জঙ্গল থেকে কোন সাপ, পোকামাকড়ও তো বের হয়ে আসতে পারে। জঙ্গলের দিকে তাকাতে তাকাতে  হঠাৎ করে ফাহিমের মনে হয়, যেন কোন একটা হলুদ কাপড় পড়া কেউ গাছের ওপরে বসে আছে, অনেকটা যেন কোন হলুদ শাড়ি পড়া মহিলা। ফাহিম বুঝতে পারে এত রাতে কোন মহিলা গাছের ওপরে থাকতে পারে না। কিন্তু তার মনে হয় যদি এটা মানুষ না হয়ে অন্য কোন অশরীরী কিছু হয়!  তার বুক ধড়ফড় করে। 

সে একবার ভাবে সে কি উল্টা দিকে হেঁটে স্টেশনের দিকে চলে যাবে? দৌড় দিবে? কিন্তু সে চিন্তাটা বাতিল করে দেয়। এত রাতে স্টেশনে ফিরেও সে যে নিরাপদে কোথাও থাকবার মত জায়গা পাবে তারই বা নিশ্চয়তা কি? তাই সে আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগোতে থাকে, আরও খানিকটা যাওয়ার পরে বজ্রপাতের আলোয় ফাহিম এবার সামনের সেই মহিলার মত দেখতে অবয়বটা পরিষ্কার দেখতে পায়। সে দেখতে পায় দুইটা কলা গাছের বড় বড় পাতা একসাথে এমন ভাবে জোড়া লেগেছে, যেন মনে হচ্ছে হলুদ কাপড়ের ঘোমটা পড়া কোন মহিলা গাছের মাথায় বসে আছেন। হয়তো যদি ফাহিমের মনে কোন ভয় না আসত, তাহলে সে এমন কিছু দেখত না। সে এবার যেন একটু স্বস্তি পায়। 

কিছু দূর হাঁটার পরে বাতাসের বেগ আরো কমে আসে। এবার ফাহিমের মনে হয় যেন কেউ তার পিছনে পিছনে হাঁটছে। যখন সে আস্তে আস্তে হাঁটছে, তখন পিছনের সেইটাও আস্তে আস্তে হাঁটছে। সে থেমে গেলে যেন পিছনের সেইটাও থেমে যাচ্ছে। সে যখন পিছন ফিরে তখন সে কাউকে দেখতে পায় না। সে যদি একটু জোর পায়ে হাঁটে, তার পিছনের সেইটাও যেন জোড় পায়ে হাঁটে। কিছুক্ষণ পর ফাহিম বুঝতে পারে আসলে তার পিছনে কিছুই নেই, সেই অন্য কোন কিছুর শব্দ আসলে তার পায়ের শব্দ, তার পা ছাড়া আর কোন জনমানুষ বা অন্য কোন প্রাণী আশেপাশে নেই। ফাহিম এবার আস্তে আস্তে এগোতে শুরু করে।

কিছুক্ষণ এগোবার পরে হঠাৎ করে একটা ভীষণ শব্দে বজ্রপাত হয়। ঠিক রাস্তায় নয়, রাস্তার পাশে একটা তাল গাছের ওপরে বজ্রপাত হয়। বজ্রপাতের তীব্র ঝলকানিতে ফাহিমের চোখ যেন ঝলসে আসে। বজ্রপাতের শব্দে তার কানে যেন তালা লেগে যায়। ফাহিম হঠাৎ করে রাস্তায় শুয়ে পড়ে, কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হয় তার যেন কোন অনুভূতি কাজ করছে না। কিছুক্ষণ পরে তার সম্বিত ফিরে পায়। সে বুঝতে পারে, এই বজ্রপাতটা আর মাত্র পঞ্চাশ-একশো গজ এদিক ওদিক পড়লেই এটি তার ওপরেই পড়ত, তার আর বাড়ি ফেরা হত না।

হঠাৎ করে কেমন যেন এক মিশ্র অনুভূতি, আকস্মিক এক মৃত্যু ভয় বা নতুন জীবন লাভের অনুভূতি ফাহিমকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ফরিদার চিঠি, মামা-মামীকে সামলানো, মাস্টার্স পরীক্ষা, চাকরি সবকিছুই যেন তার কাছে তুচ্ছ হয়ে পড়ে। যাহোক কিছুক্ষণ পরে আবারও একটু নিজেকে ফিরে পেয়ে আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগুতে থাকে। তাকে আবার সিগারেটের পিপাসা পেয়ে বসে। সে তার ব্যাকপ্যাকে যত্ন করে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ফেলে, সিগারেটটা তার কাছে একটু ভেজা-ভেজা লাগে। সে বুঝতে পারে না সিগারেট ভেজা ভেজা লাগছে কেন, তার ব্যাকপ্যাক তো রেইনপ্রুফ হওয়ার কথা। সে লাইটারটা কয়েকবার ধরিয়েও সিগারেটটা জ্বালাতে পারে না। সে বিরক্ত হয়ে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে হাঁটতে থাকে। 

কিছুক্ষণ হাঁটার পরে সে দেখে একটা মোটা দড়ির মত কিছু একটা রাস্তার একপাশ থেকে অন্য পাশে হেলেদুলে দুলকি চালে এগুচ্ছে। মনে হয় না সেই বস্তুর কোন তাড়া আছে, সে যেন রাজকীয় ভাবে রাস্তায় চলছে। ফাহিম ঠিক বুঝতে পারে না এটা কোন প্রাণী, নাকি বস্তু! আরো খানিকটা এগোনোর পরে সে লক্ষ্য করে এতো বেশ বড়সড় আকারের একটা সাপ। ফাহিম সাপ ওভাবে চিনে না, সে সাপের প্রজাতি জানে না, কিন্তু তার  সাপের চেহারা দেখে মনে হয়, এটি ঢোঁড়া সাপের মত কোনো নির্বিষ সাপ নয়, বিষধর কোন সাপ। সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়, সে বুঝতে পারে সামনে বা পিছনে কোনভাবে এগুনোই তার জন্য খুব একটা নিরাপদ হবে না। সে অপেক্ষা করে যদি সাপটা রাস্তা পেরিয়ে আবার নিচের  জলাশয়ে চলে যায়। ধীরে ধীরে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে সাপটি পার হয়, কিন্তু ফাহিমের মনে হয় যেন অনেক সময় ধরে সে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। 

হাঁটতে হাঁটতে ফাহিম প্রায় গ্রামের কাছে চলে এসেছে এমন সময় হঠাৎ করে দুই-তিনটা কুকুর এসে ঘেউ ঘেউ করে তাকে ঘিরে ধরে। ফাহিম এমনিতে কুকুরকে খুব ভয় পায়, কিন্তু আজকে কেন জানি না কুকুরকে দেখে ভয় পেলেও তার মাথাটা ঠান্ডাই থাকে। তার মনে পড়ে যায়, সে গত মাসেই রিডার্স ডাইজেস্টে পড়েছে যে কুকুরদের এক অদ্ভুত ধরনের ক্ষমতা রয়েছে, মানুষ যখন ভয় পায় তখন মানুষের শরীর থেকে এক বিশেষ ধরনের হরমোন নিসৃত হয় যা কুকুর ঠিকই টের পেয়ে যায়, তখন কুকুরও সেই মানুষকে পেয়ে বসে। সে এমনভাবে চোখমুখ শক্ত করে হাঁটতে শুরু করে যেন কিছুই হয়নি। সে অবশ্য মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে, একেবারেই যদি কুকুর তার গায়ের উপরে চলে আসতে শুরু করে সে কিছু একটা নিয়ে কুকুরকে এমন ভাবে ভঙ্গি করবে যেন সে কুকুরকে এখনই সেটা ছুঁড়ে দিবে। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হয় না, কুকুর কিছুক্ষণ পর তার পাশে চলার পর কেমন জানি উৎসাহ হারিয়ে  রাস্তার এক অন্য দিকে হাঁটা শুরু করে। ফাহিম আস্তে আস্তে এগোতে থাকে। ঘড়ির দিকে না তাকিয়েও ফাহিম বুঝতে পারে যে রাত প্রায় এগারোটা বেজে গিয়েছে। সে ঠিক বুঝতে পারেনা কাকে সে ডাকবে। মামা-মামী তো এশার নামাজ পড়েই নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে গিয়েছেন। সে কি ফরিদাকে ডাকবে? ফরিদাকে ডাকলে যদি আশেপাশের প্রতিবেশী কারোর ঘুম ভেঙে যায়? তারাই বা কি বলবে? 

একটু ইতস্তত করেও শেষে সে ফরিদা-ফরিদা বলে ডাকতে শুরু করে। ফরিদা কোন জবাব দেয়ার আগেই কোন উচ্ছ্বাস বা স্বস্তি নয়, রাজ্যের ক্লান্তি যেন ফাহিমকে পেয়ে বসে। সে যেন আর কিছুই ভাবতে পারে না। সে যেন তার স্কুল জীবনের ডিসেম্বর মাসের বার্ষিক পরীক্ষা শেষের পরের সময়ে চলে যায়, যখন পরীক্ষা শেষে করার কাজের তালিকাটা শুধু মনেই থাকত, কিন্তু সেগুলো আর করা হয়ে ওঠত না। ফাহিম বাড়ির সামনের বসার তাকে ধপ করে বসে পড়ে।


[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন