জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত সিপিডি

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি সরকারের রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলেছে, তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে অর্থনীতি ও জনগণের জীবনযাত্রায় চাপ বাড়বে, তৈরি হবে অশোভন পরিস্থিতি। তাই জ্বালানি তেলের বাড়তি দাম প্রত্যাহার করা উচিত।

গতকাল সিপিডি কার্যালয়ে ‘জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি কতটুকু প্রয়োজন ছিল?’ শীর্ষক হাইব্রিড মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলা হয়। সংবাদ সম্মেলনে জ্বালানি তেলের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘যে হারে দাম বাড়ানো হয়, বাজারে তার চেয়ে বেশি হারে প্রভাব পড়ে। তেলের দাম ২৮ শতাংশ বাড়ানো হলেও বাসের ভাড়া প্রকৃতপক্ষে ৫০ শতাংশ বেশি নেয়া হচ্ছে। মূল্য নির্ধারণের মেকানিজমে আমরা বৈজ্ঞানিক কোন মেথড দেখি না। আমরা যদি আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকি, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে যখন মূল্য কম থাকে তখন সেটার সুফল কেন জনগণ পায় না? যখন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি হয়, লোকসানের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ানো হয়। এটা বৈজ্ঞানিক বা সঠিক যুক্তি বলে মনে হয় না।’

সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অর্থনেতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই মুহূর্তে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। নৈতিকভাবেও ঠিক হয়নি। রাজনৈতিকভাবেও এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত।’

এ বিষয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হয়নি। এটি সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত। দেশে বিদ্যমান সরকার নিয়ন্ত্রিত মূল্য কাঠামোর সঙ্গে হঠাৎ অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে হবে না। ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে প্রতিযোগিতামূলক মূল্য কাঠামোর দিকে যাওয়ার দরকার আছে। তবে করোনা মহামারীর এ মুহূর্তে নয়।’

বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় দেশে বাড়ানো হয়েছে, সরকারের এ ব্যাখ্যা নিয়ে সিপিডির অবস্থান জানতে চাইলে সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘অন্য দেশে যখন দাম কম ছিল, দেশে তখন কমানো হয়নি কেন? করোনার মধ্যেও জনগণের কাছ থেকে সরকার জ্বালানি তেলে বাড়তি টাকা নিয়েছে। সেই টাকায় এখন ঘাটতি পূরণ করার কথা। সরকার জনগণের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করেছে। সামাজিক ন্যায়বিচারের দিক থেকে সিদ্ধান্ত হয়নি।’

মূল্যবৃদ্ধির নানা নেতিবাচক দিক তুলে ধরে জ্বালানি তেলের দাম আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করেন তিনি।

সিপিডি বলছে, জ্বালানি তেলের মূল্যস্ফীতির চাপ ধনীদের স্পর্শ করবে না। তবে নি¤œ ও মধ্যবিত্তের সমস্যা হবে। তেলের দাম বৃদ্ধি সরকারের রাজনৈতিক ভুল। প্রণোদনা হিসেবেও এই ব্যয় সমন্বয় করা যেত। আর ধর্মঘট করে চাপ দিয়ে বাসের ভাড়া অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি করে নেয়া রাজনৈতিক দুর্বলতার ফল বলে মনে করে সিপিডি।

জ্বালানি তেলের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য বিশ্লেষণ করে সিপিডি জানায়, গত সাত বছরে এ বাবদ সরকারের লোকসানের চেয়ে মুনাফার পরিমাণ বেশি। এ ছাড়া বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বিক্রি ও সরবরাহ পর্যায়ে শুল্ক প্রত্যাহার করে নিলেই দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন পড়তো না। করোনার অভিঘাত থেকে পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় জ্বালানি তেলের দর বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে সাধারণ জনগণ চাপে পড়বে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে। বিপিসি’র ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি আছে, অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতি হয়। ভর্তুকি থেকে সরকারকে বের হতে হবে, তবে এখন সেই উপযুক্ত সময় নয়। কারণ এখনও করোনা মহামারী বিদ্যমান।

সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে তেলের দাম নিয়মিত ওঠানামা করে। ২০১৬ সালে প্রতি ব্যারেল ৪২ ডলার হওয়ার পর দেশে ডিজেলের দাম কমিয়ে ৬৫ টাকা করা হয়। এরপর করোনার প্রভাবে গত বছর ২৩ ডলারে দাম নেমে এলেও দেশে কমানো হয়নি। এ বছর ৮৩ ডলারে পৌঁছালে দেশে একলাফে ১৫ টাকা বাড়ানো হয় প্রতি লিটারে। অথচ গত ৭ বছরে বিপিসি মুনাফা করেছে ৪৩ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। এর আগে ২০০৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত বিপিসি লোকসান করেছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। সব মিলেও লাভে আছে বিপিসি।

সিপিডি বলছে, জ্বালানি তেলে ৩৪ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও লভ্যাংশ মিলে প্রতিবছর বিপুল টাকা জমা হচ্ছে সরকারি কোষাগারে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। এর আগের অর্থবছরে এটি ছিল ৯ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা।

বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর ২০২১ , ২৬ কার্তিক ১৪২৮ ৫ রবিউস সানি ১৪৪৩

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত সিপিডি

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি সরকারের রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলেছে, তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে অর্থনীতি ও জনগণের জীবনযাত্রায় চাপ বাড়বে, তৈরি হবে অশোভন পরিস্থিতি। তাই জ্বালানি তেলের বাড়তি দাম প্রত্যাহার করা উচিত।

গতকাল সিপিডি কার্যালয়ে ‘জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি কতটুকু প্রয়োজন ছিল?’ শীর্ষক হাইব্রিড মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলা হয়। সংবাদ সম্মেলনে জ্বালানি তেলের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘যে হারে দাম বাড়ানো হয়, বাজারে তার চেয়ে বেশি হারে প্রভাব পড়ে। তেলের দাম ২৮ শতাংশ বাড়ানো হলেও বাসের ভাড়া প্রকৃতপক্ষে ৫০ শতাংশ বেশি নেয়া হচ্ছে। মূল্য নির্ধারণের মেকানিজমে আমরা বৈজ্ঞানিক কোন মেথড দেখি না। আমরা যদি আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকি, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে যখন মূল্য কম থাকে তখন সেটার সুফল কেন জনগণ পায় না? যখন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি হয়, লোকসানের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ানো হয়। এটা বৈজ্ঞানিক বা সঠিক যুক্তি বলে মনে হয় না।’

সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অর্থনেতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই মুহূর্তে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। নৈতিকভাবেও ঠিক হয়নি। রাজনৈতিকভাবেও এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত।’

এ বিষয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হয়নি। এটি সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত। দেশে বিদ্যমান সরকার নিয়ন্ত্রিত মূল্য কাঠামোর সঙ্গে হঠাৎ অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে হবে না। ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে প্রতিযোগিতামূলক মূল্য কাঠামোর দিকে যাওয়ার দরকার আছে। তবে করোনা মহামারীর এ মুহূর্তে নয়।’

বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় দেশে বাড়ানো হয়েছে, সরকারের এ ব্যাখ্যা নিয়ে সিপিডির অবস্থান জানতে চাইলে সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘অন্য দেশে যখন দাম কম ছিল, দেশে তখন কমানো হয়নি কেন? করোনার মধ্যেও জনগণের কাছ থেকে সরকার জ্বালানি তেলে বাড়তি টাকা নিয়েছে। সেই টাকায় এখন ঘাটতি পূরণ করার কথা। সরকার জনগণের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করেছে। সামাজিক ন্যায়বিচারের দিক থেকে সিদ্ধান্ত হয়নি।’

মূল্যবৃদ্ধির নানা নেতিবাচক দিক তুলে ধরে জ্বালানি তেলের দাম আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করেন তিনি।

সিপিডি বলছে, জ্বালানি তেলের মূল্যস্ফীতির চাপ ধনীদের স্পর্শ করবে না। তবে নি¤œ ও মধ্যবিত্তের সমস্যা হবে। তেলের দাম বৃদ্ধি সরকারের রাজনৈতিক ভুল। প্রণোদনা হিসেবেও এই ব্যয় সমন্বয় করা যেত। আর ধর্মঘট করে চাপ দিয়ে বাসের ভাড়া অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি করে নেয়া রাজনৈতিক দুর্বলতার ফল বলে মনে করে সিপিডি।

জ্বালানি তেলের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য বিশ্লেষণ করে সিপিডি জানায়, গত সাত বছরে এ বাবদ সরকারের লোকসানের চেয়ে মুনাফার পরিমাণ বেশি। এ ছাড়া বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বিক্রি ও সরবরাহ পর্যায়ে শুল্ক প্রত্যাহার করে নিলেই দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন পড়তো না। করোনার অভিঘাত থেকে পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় জ্বালানি তেলের দর বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে সাধারণ জনগণ চাপে পড়বে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে। বিপিসি’র ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি আছে, অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতি হয়। ভর্তুকি থেকে সরকারকে বের হতে হবে, তবে এখন সেই উপযুক্ত সময় নয়। কারণ এখনও করোনা মহামারী বিদ্যমান।

সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে তেলের দাম নিয়মিত ওঠানামা করে। ২০১৬ সালে প্রতি ব্যারেল ৪২ ডলার হওয়ার পর দেশে ডিজেলের দাম কমিয়ে ৬৫ টাকা করা হয়। এরপর করোনার প্রভাবে গত বছর ২৩ ডলারে দাম নেমে এলেও দেশে কমানো হয়নি। এ বছর ৮৩ ডলারে পৌঁছালে দেশে একলাফে ১৫ টাকা বাড়ানো হয় প্রতি লিটারে। অথচ গত ৭ বছরে বিপিসি মুনাফা করেছে ৪৩ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। এর আগে ২০০৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত বিপিসি লোকসান করেছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। সব মিলেও লাভে আছে বিপিসি।

সিপিডি বলছে, জ্বালানি তেলে ৩৪ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও লভ্যাংশ মিলে প্রতিবছর বিপুল টাকা জমা হচ্ছে সরকারি কোষাগারে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। এর আগের অর্থবছরে এটি ছিল ৯ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা।