ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৮ জুন ২০২৪, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

জ্বালানির মূল্য না বাড়ানোর পরামর্শ সিপিডির

দেশে নিত্যপণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে অনেক বেশি

প্রকাশিত: ২২:৪১, ২১ মার্চ ২০২২

দেশে নিত্যপণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে অনেক বেশি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ করোনা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে বাড়ছে জ্বালানি তেলের মূল্য। ফলে সারাবিশ্বেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে উর্ধগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। উন্নত অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক আয় কম। তবুও সেসব দেশের চেয়েও বেশি দামে চাল, তেল, ডিম, আটার মতো পণ্য কিনতে হচ্ছে এদেশের মানুষকে। বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলার অভাব, চাহিদা-যোগান সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকাসহ একাধিক কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি বলে মনে করছে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির মতে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়তি থাকলেও সিগারেটের মতো ক্ষতিকারক পণ্যের মূল্য উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। এমন অবস্থায় আগামী বাজেটে সিগারেটের ওপর কর আরোপ ও মূল্যস্ফীতির সঠিক চিত্র প্রকাশের তাগিদ দিয়েছে সিপিডি। রবিবার রাজধানীর ধানম-িতে সিপিডি কার্যালয়ে ‘পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন্ পথে’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এই অভিমত প্রকাশ করে গবেষণা সংস্থাটি। অনুষ্ঠানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি, বহিঃখাত, জ্বালানি ও বিদ্যুত, ব্যাংক খাত এবং বাজেট ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আলোচনা হয়। এখানে সিপিডির গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা তাদের মতামত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ম. তামীম, সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক ড. তৌফিকুল ইসলাম, সৈয়দ ইউসুফসহ অনেকে। আলোচনা সভায় সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, আমরা বলছি সারাবিশ্বে পণ্যের দাম বাড়ছে, সে কারণে বাংলাদেশেও বাড়ছে। চাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এক বছর ধরে ওঠানামা করছে। তারপরও এসব পণ্যের দাম বিশ্ববাজারের চেয়েও অনেক বেশি। তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অনেক বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক আয় সেসব দেশের তুলনায় অনেক কম। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশে চালের দাম বেশি জানিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, অথচ এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে চাল বেশি উৎপাদন হয়। এছাড়া অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ময়দার দাম অনেক বেশি। তেলের ক্ষেত্রে আমরা একই চিত্র দেখছি। দামের ফারাকটা অনেক বেশি। গরুর মাংসেও একই অবস্থা। চিনি, পেঁয়াজের মূল্যেও উর্ধগতি। ইউরোপ, আমেরিকার বাজারের তুলনায় দাম কয়েকগুণ বেশি। সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়, গুঁড়ো দুধের মূল্য ইউরোপের বাজারের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। কিন্তু দেখা গেছে, তাদের মাসিক আয় আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। দেশে ডিম প্রতিডজন ১১০ টাকা হলেও আমেরিকায় ১০৩ ও মালেশিয়ায় ৮৫ টাকা। অন্যদিকে সিগারেটের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় প্রায় ৮ গুণ কম। নির্দিষ্ট একটি ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের ম্ল্যূ অস্ট্রেলিয়ার পার্থে দুই হাজার ৫১৬ টাকা, নিউজিল্যান্ডে দুই হাজার ১০৩ টাকা, ইংল্যান্ডে এক হাজার ৪৮৮ টাকা হলেও বাংলাদেশে মাত্র ৩০১ টাকা। এসব বিষয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, একদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী, কিন্তু আবার আমরা দেখছি সরকারী তথ্যে মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল। এটি একটি বিপরীতমুখী প্রবণতা। যখন এত মূল্য বাড়ছে তখন মূল্যস্ফীতি কীভাবে স্থিতিশীল থাকে তা আশ্চর্যের বিষয়। কোভিডকালীন সারাবিশ্বে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এখন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সেটা আরও বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে তা স্থিতিশীল! তার মতে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির একটি বাড়লে আরেকটি কমে। এটাই বিগত কয়েক বছরের ট্রেন্ড। ফলে ওভারঅল একটা স্থিতিশীল মূল্যস্ফীতি বজায় থাকে। কিন্তু এটি আসলে বাজারের সঠিক চিত্র প্রকাশ করে না। পণ্য কিনতে গিয়ে আমরা কিন্তু স্থিতিশীল মূল্যস্ফীতি লক্ষ্য করছি না। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, মূল্যস্ফীতি পরিমাপ করার জন্য যে স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয় সেটা গত কয়েক বছর ধরে একই আছে। গত এক বছরে জ্বালানি তেলের মূল্য প্রায় ৫০ ভাগ বেড়েছে বলেও জানায় গবেষণা সংস্থাটি। ফাহমিদা খাতুন বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে কী ধরনের কৌশল নেয়া যেতে পারে, সেটা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। আমরা দেখছি বিভিন্ন দেশ তেলের মজুদ সমৃদ্ধ করার জন্য তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোতে ধরনা দেয়া শুরু করেছে। আমাদেরও একইভাবে রিজার্ভ করার উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন আছে। বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে সিপিডি যেসব সুপারিশ দিয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে ব্যবস্থা নেয়া, বাজার ব্যবস্থাপনায় নজরদারি ও তদারকি বাড়ানো, রোজায় পণ্যের উর্ধগতি ঠেকাতে পদক্ষেপ নেয়া। এছাড়া নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য ন্যায্যমূল্যে পণ্য নিশ্চিত করতে টিসিবি ও ওএমএসের কার্যক্রম বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে সিপিডি। সংস্থাটি বলছে, খাদ্য ও পণ্যের চাহিদা-যোগান সম্পর্কে সরকার সঠিক তথ্য পায় না। ফলে বাজার ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। চাহিদা ও যোগান সম্পর্কে সরকারের স্পস্ট ধারণা রাখতে হবে। একই সঙ্গে দরিদ্রদের জন্য প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তা দিতে হবে ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাড়াতে হবে। সিপিডি জানিয়েছে, রফতানি বাড়ছে, কিন্তু সেই তুলনায় আমদানি বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহও কমে গেছে। কয়েকটি পণ্য আমাদের ও বিশ্ব অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যার মধ্যে রয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্য। কৌশলের অংশ হিসেবে আগেভাগেই জ্বালানি তেলের মজুদ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের মূল্যও অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সেটা আরও বেড়েছে। ফেব্রুয়ারির শেষে তেলের মূল্য ব্যারেল প্রতি ৯৫ দশমিক ৮ ডলার ও মার্চে ১০০ ডলার ছাড়িয়েছে। যেখানে এক বছর আগেও ব্যারেল প্রতি ৬৫ ডলার ছিল। আশঙ্কা হচ্ছে, যুদ্ধ যদি না থামে সামনে দাম আরও বাড়বে। সিপিডির মতে, সরকারী ব্যয় সুচিন্তিতভাবে করা দরকার। যে ধরনের প্রকল্পে মানুষের কর্মসংস্থান হয়, সে ধরনের ব্যয় করতে হবে। আর যত প্রকল্প চলমান, সেগুলো দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। অন্যদিকে দেশে ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপী বেড়েই চলেছে। ব্যাংকগুলোকে ঋণ খেলাপীর বিষয়ে এক ধরনের শৈথিল্য দেয়া হয়। তারপরও এর উন্নতি হয়নি, বরং অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এসব বিষয়ে নজর দেয়ার পাশাপাশি বাজেট ব্যবস্থাপনায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সাধারণ মানুষদের সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ চেয়েছে সিপিডি। আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সরকার যদি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম না বাড়ায়, তাহলে অর্থনীতিতে চাপ আসবে না। কারণ, এই চাপ সামলানোর মতো সক্ষমতা আছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এখন পর্যন্ত যে ঘাটতি আছে, তা সহনীয়। এ ছাড়া সরকারের কাছে পর্যাপ্ত তারল্য আছে। কাজেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হবে না। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ালে অর্থনীতিতে যে চাপ সৃষ্টি হবে, তা সামাল দেয়া সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। সুতরাং এসব পণ্যের দাম বাড়ানো সঠিক হবে না। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ভর্তুকিতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে সরকারকে কৌশলী হতে হবে। স্মার্ট বা চতুর নীতি গ্রহণ করতে হবে। চতুর ভর্তুকির অর্থ হলো যাদের জন্য ভর্তুকি প্রয়োজন, সেই টার্গেট গ্রুপ যাতে ভর্তুকি পায়, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ বাজারভিত্তিক হওয়া উচিত। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের রফতানির পরিমাণ বাড়ছে, কিন্তু সে অনুযায়ী মূল্য পাচ্ছি না। আবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেশি হচ্ছে। ফলে বাণিজ্যব্যবস্থা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। এটি আমাদের জন্য বর্তমানে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, গ্যাস, বিদ্যুত ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে; জিডিপি কমে যাবে। অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নামবে। সরকারের এ পদক্ষেপ নেয়া ঠিক হবে না।
×