ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি সমস্যা মেটাতে চায় মন্ত্রণালয়, সাফল্য নিয়ে শঙ্কা বিশিষ্টজনদের

ভূমি মন্ত্রণালয়

বাংলাদেশে জমি নিয়ে লড়াই-সংঘাত হবে না তা কল্পনা করা যায় না। ডিজিটাল পদ্ধতিতে এই সংঘাতের নিরসন চায় ভূমি মন্ত্রণালয়। কিন্তু এতে করে স্বার্থান্বেষী মহলের উদ্ভব হয় কি না, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনেরা। কারণ, দেশের দুই–তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ ইন্টারনেট–সুবিধার বাইরে।

আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইন মিলনায়তনে আয়োজিত এক ‘নীতি সংলাপে’ এই শঙ্কার কথা জানান বিশিষ্টজনেরা। তবে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা এমন পদ্ধতি করছেন, যাতে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দুর্নীতি করার সুযোগ থাকবে না।

নাগরিক প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে আয়োজিত এ সংলাপে সহযোগিতা করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান।

সংলাপে সভাপতির বক্তব্যে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘জমি নিয়ে সংগ্রাম–সংঘাত হবে না, এটা কল্পনাই করা যায় না। ১৯৮৪ সালে ভূমি সংস্কারে আইন হয়েছিল, ২০০১ সালে ভূমি ব্যবহারের ওপর একটি নীতি হয়েছিল। সেগুলো খুব যথাযথভাবে কার্যকর করা হয়নি।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমান সময়ে লক্ষ করা যাচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে বিশেষ করে সাধারণ মানুষ যাতে দুর্নীতিমুক্তভাবে, ঝামেলামুক্তভাবে, বাধাহীনভাবে সেবা পেতে পারেন, সেই চেষ্টা করা হয়েছে।

ইন্টারনেট সুবিধাবঞ্চিত মানুষ কীভাবে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল সেবা নেবেন, সে সম্পর্কে ভূমিমন্ত্রী বলেন, তাঁদের সেবা দিতে শিক্ষিত যুবসমাজ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতে পারে। মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিটি এলাকায় অনুমোদিত প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া হবে। নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে প্রতিনিধিরা সহায়তা করবেন। প্রতিনিধিরা অতিরিক্ত ফি নিলে তাঁদের অনুমোদন বাতিল করা হবে।

‘ভূমি ব্যবস্থাপনায় সাম্প্রতিক উদ্যোগ ও নাগরিক অধিকার’ শীর্ষক এ সংলাপে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে ৬৯ শতাংশ মানুষ এখনো ইন্টারনেটের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আবার ইন্টারনেটের গতি দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। এই দুটির সংমিশ্রণে জনগণকে বঞ্চিত করার জন্য একধরনের স্বার্থান্বেষী মহলের উদ্ভব হতে পারে বলে তাঁর আশঙ্কা। তিনি বলেন, ‘ডিজিটালাইজেশন হচ্ছে একধরনের মেশিন। এই মেশিন যাঁরা চালাবেন, তাঁরা শুদ্ধাচার চর্চা না করলে, সুফল পাওয়া যাবে না।’

এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষই খারাপ আর বিদেশের মানুষই সব ভালো—তা না। আমরাও ভালো মানুষ। বিদেশের মানুষেরও ইচ্ছা হয় একটু দুর্নীতি করার—কিন্তু পারে না, কারণ সিস্টেমে তো নাই। আমরাও এ ধরনের কাজ করছি, এমনভাবে সিস্টেমটা ডেভেলপ করব যে এর বাইরে কারও যাওয়ার সুযোগ নেই।’

ইন্টারনেট সুবিধাবঞ্চিত মানুষ কীভাবে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল সে নেবেন, সে সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, তাঁদের সেবা দিতে শিক্ষিত যুবসমাজ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতে পারে। মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিটি এলাকায় অনুমোদিত প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া হবে। নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে প্রতিনিধিরা সহায়তা করবেন। প্রতিনিধিরা অতিরিক্ত ফি নিলে তাঁদের অনুমোদন বাতিল করা হবে।

আমাদের কাছে কোনো ম্যাজিক নেই; যা দিয়ে সব মানুষের স্বভাব পরিবর্তন হয়ে যাবে। সে কারণে সিস্টেমগুলোকে এমনভাবে ডিজাইন করছি যে মানুষ দুষ্টমি করার চেষ্টা করলেও পারবে না।
—মোস্তাফিজুর রহমান, সচিব, ভূমি মন্ত্রণালয়

অনুষ্ঠানে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক উদ্যোগ সম্পর্কে বক্তব্য দেন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ভূমি ব্যবস্থাপনার শুরুতে সরকারকে জানতে হয় কোন ভূমি কে দখলে আছে, কে মালিক, কোন পজিশনে আছে, কতটুকু জমি। সরকার জরিপের মাধ্যমে এটি জানতে পারে। সারা দেশে একটি ডিজিটাল জরিপ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই জরিপের পর নতুন করে আর কোনো জরিপের প্রয়োজন হবে না, ডিজিটাল খতিয়ান তৈরি করা হবে।

জমির নামজারির কাজ অনলাইনে হচ্ছে উল্লেখ করে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগামী বৈশাখ থেকে জমির খাজনাও সম্পূর্ণ অনলাইনে নেওয়া হবে, সনাতনী পদ্ধতি বন্ধ করে দেওয়া হবে। ২৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি অ্যাপের উদ্বোধন করবেন; যার মাধ্যমে মৌজায় দাঁড়িয়ে অ্যাপটি খুললে কোন প্লটে দাঁড়িয়ে আছেন, সেটি দেখা যাবে।

দুর্নীতির শঙ্কা সম্পর্কে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাছে কোনো ম্যাজিক নেই; যা দিয়ে সব মানুষের স্বভাব পরিবর্তন হয়ে যাবে। সে কারণে সিস্টেমগুলোকে এমনভাবে ডিজাইন করছি যে মানুষ দুষ্টমি করার চেষ্টা করলেও পারবে না।’

সংলাপে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ভূমি নিয়ে জটিলতা যুগ যুগ ধরে। মানুষ নানা ধরনের বঞ্চনা, কষ্ট ও সহিংসতার শিকার। ভূমি ব্যবস্থাপনায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগগুলোর কথা বলা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হলে ভূমিসংক্রান্ত সংকট নিরসনে বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হবে।

এই সরকারের সময় যতগুলো ভালো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে মন্তব্য করেন শাহীন আনাম। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে তিনি ভূমি নিয়ে নারীদের বঞ্চনা দূর করা ও খাসজমির ক্ষেত্রে ভূমিদস্যুদের নিয়ন্ত্রণ করার আহ্বান জানান।

সংলাপের আরও বক্তব্য দেন এটুআই প্রকল্পের ন্যাশনাল পোর্টাল ইমপ্লিমেন্টেশন স্পেশালিস্ট মোহাম্মদ শামসুজ্জামান, আইনজীবী মাহফুজ বিন ইউসুফ, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) ব্যবস্থাপক (কর্মসূচি) রফিক আহমেদ সিরাজী প্রমুখ।