বিয়ের সেই সাজসজ্জা
বিয়ে মানেই একটা সাজ সাজ রব। শুধু বর–কনেই নয়, আত্মীয়স্বজনসহ অভ্যাগতরা তো বটেই, পুরো বাড়িই সেজে ওঠে বৈচিত্র্যময় সাজে। না হলে বিয়েবাড়ি ঠিক জমে না। এ সাজের রয়েছে রকমফের, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তার ঘটেছে বিবিধ রূপান্তর।
এই একুশ শতকে নগর কিংবা গ্রাম সবখানেই লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। কিন্তু পারিবারিক ছবির অ্যালবামগুলো ঘাঁটলে পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের বিয়ের যে ধূসর ছবিগুলো স্মৃতি জাগিয়ে তোলে, সেগুলো বলে ভিন্ন কথা। একটু বিশদে বলা যাক।
বিয়ের দুই প্রধান চরিত্র বর ও কনে। এ দুজন সবকিছুর মধ্যমণি, সাজসজ্জারও। এখন গায়েহলুদ থেকে শুরু করে বিয়ের দিন পর্যন্ত বর–কনের সাজসজ্জা মানেই পারলার। নিদেনপক্ষে প্রশিক্ষিত সজ্জানিপুনা কোনো বিউটিশিয়ানকে ডেকে আনা। কিন্তু বছর ১৫ আগেও, এমনকি গ্রামের দিকে এখনো কোনো কোনো এলাকায় বর–কনের সাজসজ্জায় প্রধান ভূমিকা পালন করেন বাড়ির বা পাশের বাড়ির ‘সর্বকর্মপটীয়সী’ কোনো আপা কিংবা ভাবি। এই করোনাকালের বিয়েতে তাঁদের কদর যেন আবার বাড়তে শুরু করেছে।
বিয়ের আগের দিন রাতভর মেহেদি লাগানো হবে হাতে। রাতভর হইহুল্লোড়ের মাঝে চলবে হাতে মেহেদি লাগানো, পায়ে আলতা লাগানোর পালা—এসব আমাদের বিয়েবাড়ির অকৃত্রিম গল্প। হ্যাঁ, তখন ছিল বাটা মেহেদির যুগ, কাজলদানির যুগ, আলতার বোতলের যুগ, কাজলদানিতে বানানো কাজলে চোখ সাজানোর যুগ, জরি–চুমকি ছাড়াই বানানো বাহারি বেণির যুগ।
হাতের মেহেদি হোক বা কনের চুল, ভ্রুটা খানিক আকর্ষণীয় করাই হোক বা গালে হালকা গোলাপি আভা ফুটিয়ে তোলা, পুরোটাই নিপুণ হাতে করতেন সেই ‘মুশকিল আসান’ আপা কিংবা ভাবি। সঙ্গে থাকত সজ্জা বিষয়ে নিপুণ হয়ে উঠতে আগ্রহী বয়সে নবীন কোনো নারী।
কনের পোশাক ও অলংকার পছন্দের ক্ষেত্রে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠা নারীদের কথাই ‘শেষ কথা’। সবকিছু পছন্দ করে কিনে এনে সাজানোর ভার তুলে দেওয়া হতো সজ্জানিপুনা সেই ভাবি বা আপার হাতে। তিনি ধীরে ধীরে বসনভূষণে আবৃত করে সাজিয়ে তুলতেন জীবনের নতুন পর্বে প্রবেশ করতে যাওয়া কনেকে।
বরের সাজসজ্জাতেও ডাক পড়ত বাড়িরই কোনো নারীর। তবে পুরুষের চেয়ে নারীর সাজসজ্জার প্রচলন ও বৈচিত্র্য বেশি বলে বরের সাজসজ্জা এখন যেমন গুরুত্ব পায়, তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না একটা সময়। হালকা প্রসাধন, হয়তো কপালে চন্দনের ফোঁটা, চুলের হালফ্যাশনের ছাঁট, মানানসই পোশাক সাধারণত এই ছিল বরের ‘বিয়ের সজ্জা’।
বর–কনে যতই মধ্যমণি হোক, শুধু তাঁদের সাজসজ্জাতেই বিয়েবাড়ি সম্পূর্ণতা পেত না। পুরো বাড়ির ছিল আলাদা সজ্জার ব্যাপার।
পরিষ্কার ঝকঝকে করে তোলা হতো বাড়ি। পাকা বাড়ি হলে নতুন একপ্রস্থ রং করিয়ে নেওয়া হতো। কখনো কখনো পুরোনো প্রাচীন গাছের গোড়ায়ও পড়ত সাদা রঙের পোচ। বাড়িতে পড়ত নতুন আলপনা। সাধারণত বাড়ির নারীরাই সেসব আলপনা করতেন। বর–কনের সঙ্গে পুরো বাড়ি যেন সেজে উঠত নতুন করে। বাড়ি সজ্জার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ হতো বিয়ের দিন।
বাড়ির সাজসজ্জার ভার পড়ত কিশোর–তরুণদের ওপর। উচ্ছ্বাস আর অস্থিরতায় কাঁচা হাতে কাটা বেশুমার রঙিন কাগজের শিকল, বিভিন্ন নকশায় কাটা কাগজ, দড়িতে বাঁধা কাগজের রঙিন নিশান, থরে থরে সাজানো গাঁদা ফুলের ঝুল, সরু দড়িতে ঝোলানো দেবদারু কিংবা আমপাতার কারুকার্য, বাঙালির আবহমান বিয়েবাড়ির সজ্জা।
বিয়ে হবে কিন্তু তার একটা সিংহদরজা তৈরি হবে না, বাঙালি কোনো দিন সেটি হতে দেয়নি। শহরে তেমন দেখা না গেলেও গ্রামীণ পরিবেশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিয়ের গেট। বাঁশের কাঠামোয় রঙিন কাপড়ে তৈরি করা বিয়েবাড়ির উঁচু গেট দূর থেকে চোখে পড়ে। সুদৃশ্য এ গেট দেখলেই বোঝা যায়, এ গ্রামে কারও বিয়ে হচ্ছে।
রঙিন শাড়ি ছিল বিয়েবাড়ির গেট সাজানোর প্রধান জিনিস। যেসব গ্রামে একসময় বিদ্যুৎ ছিল না, সেসব গ্রামে ডায়নামো কিংবা জেনারেটর দিয়ে আলোকিত করা হতো গেটে। গ্রামের তরুণ–যুবকদের হাত থেকে বিয়েবাড়ির গেট সাজানোর দায়িত্ব এখন চলে গেছে ডেকোরেটর ব্যবসায়ীদের হাতে। চাহিদা ও বাজেট মাফিক তাঁরাই এখন তৈরি করে দেন হালফ্যাশনের বিয়েবাড়ির সিংহদরজা।
শেষ করা যাক বাসরঘরের সাজসজ্জা দিয়ে। বেহুলার বাসরঘরে ছোট্ট খুঁত থাকায় অনর্থ ঘটেছিল। কিন্তু বাঙালি নিজের বাসরঘর সজ্জায় কোনো খুঁত রাখতে চায় না। ফুল আর ঝরি এ দুটি আবহমান কাল থেকে বাঙালির বাসরঘরের শোভা বাড়িয়ে চলেছে। সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া গাঁদা ফুল কিংবা রঙিন জরি, নতুন চাদরে ঢাকা বিছানায় ছড়ানো গোলাপের পাপড়ি—দৃশ্যটা অতীত–বর্তমানে প্রায় একই রকম হলেও পুরোনো হয়নি কখনো।
নতুন জীবনের শুরুতে সুসজ্জিত সুরভিত ফুলেল বাসরঘর—জীবনের এক অদ্ভুত মেটাফোর।