Search

Showing posts with label খোদেজা. Show all posts
Showing posts with label খোদেজা. Show all posts

Saturday, October 24, 2009

আমার ছায়া আমায় ছাড়িয়ে যায়।

জটিলতা এবং নৈতিকতার কারণে এখানে বাচ্চাটির নাম এবং ডাক্তারের নাম সরিয়ে দিলাম। কিন্তু মূল কপিটা আমার কাছে সংরক্ষিত আছে, ডাক্তারের নামসহ...।
 
একটি ছোট্ট শিশুর প্রতি করা হয়েছিল তার জানামতে, এক অজানা চরম লাঞ্চনা, ভয়াবহ অন্যায়।
ওই শিশুটির বাবা ওদিন আমার হাত ধরে একটা শিশুর মত কাঁদছিলেন। ওই বাবাটির হাতে ধরা ছিল এই রিপোর্টটি, ক্ষমতাবানরা টাকার জোরে তাদের পক্ষে ডাক্তারকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে। এতে পরিষ্কার লেখা আছে 'হাইমেন ইনট্যাক্ট'!
অথচ এই মেয়ে-শিশুটিকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। ধর্ষক ছেলেটি পালিয়ে যাওয়ার সময়, আই-উইটনেস থাকার পরও আদালতে এই রিপোর্টটি দাখিল করলে এই মামলা যে ডিসমিস হয়ে যাবে এ নিশ্চিত!
(এর সবটাই ওই শিশুটির বাবার বক্তব্য-মত,
এই মতের দায়-দায়িত্ব আমার না। তাঁর লিখিত সম্মতিক্রমে এখানে ছাপানো হলো। )
...
এই ছবিটি রূপক অর্থে দেয়া হয়েছে:

ওই অভাগা বাবাটির মত আমিও এক অক্ষম- কী করার ছিল আমার? কিন্তু তখন যেটা আমি করতে পারিনি 'খোদেজা' উপন্যাসে আমার সৃষ্ট চরিত্র ওবায়েদ সাহেব সেটা করে দেখিয়েছেন। আমার সৃষ্টি আমায় ছাড়িয়ে গেছে, এতে আমার কোন লাজ নাই। ওবায়েদ সাহেব, তাঁকে আমি স্যালুট করি।
... ... ...
(খোদেজা নামক উপন্যাস থেকে): "জুনাব আলি (ওসি) এবং ওবায়েদ সাহেবকে ডাঃ শাহরিয়ার বসিয়ে রেখেছেন প্রায় ১৫ মিনিট হল।
জুনাব আলি ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারে এসেই বলেছিলেন, ডাক্তার সাহেব, জরুরি দরকার। আপনার সঙ্গে কথা বলতে হবে। ঢাকা থেকে এক সার এসেছেন।

ডাঃ শাহরিয়ার
পাত্তা দেননি। সিভিল সার্জন, এস, পির সঙ্গে তার যথেষ্ট হৃদ্যতা আছে। হেলাফেলা ভঙ্গিতে বলেছিলেন, আপনি দেখছেন না, রোগি দেখছি।
ডাক্তার সাহেব বিষয়টা জরুরি।
আরে কি মুশকিল! এখন আমার পিক আওয়ার, সন্ধ্যায় আসেন।
ডাক্তার সাহেব, কিছু মনে করবেন না। সন্ধ্যায় তো সার থাকবেন না, ঢাকায় ফিরে যাবেন।
ডাঃ শাহরিয়ার রেগে গিয়েছিলেন, না থাকলে নাই। আপনার সার কি ঘোড়ায় চড়ে এসেছেন! যান, অপেক্ষা করতে বলেন, রোগি দেখা শেষ করে আলাপ করব।

জুনাব আলি শংকিত দৃষ্টিতে দরোজার ফাঁক দিয়ে খানিক তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। ওবায়েদ সাহেব বাইরে যেখানে বসে অপেক্ষা করছিলেন, ওখানে এই কথাবার্তাগুলো না-শুনতে পাওয়ার কোন কারণ নাই। কিন্তু মানুষটার নির্বিকার ভঙ্গি, শুনেছেন কি শোনেন নাই বোঝা যাচ্ছে না।
বের হয়ে জুনাব আলি মৃদু গলায় বলেছিলেন, সার-।
ওবায়েদ সাহেব হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিয়েছিলেন, হুম-ম!

ভেতরের রোগি বের হয়ে এলে আরেকজন রোগি ঢুকতে যাচ্ছিল। এইবার ওবায়েদ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। হিম গলায় বললেন, জুনাব আলি, এই রোগিকে জিজ্ঞেস করেন কি সমস্যা নিয়ে এসেছে। খুব জরুরি কিছু না হলে বলেন একটু অপেক্ষা করতে।
জুনাব আলি কথা বলে দেখলেন খুব জরুরি কিছু না। ওবায়েদ সাহেব কালমাত্র বিলম্ব না করে ভেতরে ঢুকলেন।
চেয়ারে বসতে বসতে
ডাঃ শাহরিয়ারকে বললেন, হ্যালো ডক, আপনি ভুল ভাবছেন, আমি কিন্তু ঘটক না। বিবাহের কোন সমস্যা নিয়ে আপনার কাছে আসি নাই যে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকব।
ডাঃ শাহরিয়ার স্তম্ভিত। কেউ তার সঙ্গে এমন ভাষায় কথা বলছে এটা মেনে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে। সামলে নিয়ে বললেন, আপনি কে, মুখ সামলে কথা বলুন।
না বললে?
আপনি জানেন আমি আপনাকে জেলের ভাত খাওয়াতে পারি।
ওবায়েদ সাহেব অবজ্ঞার হাসি হাসলেন, তাই নাকি! দু-নম্বরি করতে করতে ভাষাটাও দু-নম্বরি হয়ে গেছে আপনার। জেলের ভাত খাওয়ার আপনার শখ কেমন, শুনি?
জেলের ভাত খাওয়া আপনার জন্য অবশ্য খুব কঠিন কিছু না। কয়টা বলব?
আপনি এখানে প্র্যাকটিস করছেন অথচ আপনার এখন সরকারি হাসপাতালে থাকার কথা। খোঁজ নিয়েছি, আপনি ছুটিতেও নেই। বিষয়টা কী দাঁড়াল? সবচেয়ে ভয়াবহ কথাটা হচ্ছে, আজ আপনার ইমারর্জেন্সি ডিউটি।
এমনিতে এই প্যাথলজির সঙ্গে আপনার চুক্তি হচ্ছে, যত টেস্ট লিখবেন এর বিনিময়ে শতকরা ৪০ ভাগ কমিশন পাবেন। আরও বলব?
মাস ছয়েক আগে আপনার দোষে মেয়াদ উত্তীর্ন ইঞ্জেকশনের কারণে একটা শিশুর মৃত্যু হয়। আপনি চাল করে শিশুটির বাবার কাছ থেকে প্রেসক্রিপসনটা হাতিয়ে নিয়েছিলেন।
ভুয়া সার্টিফিকেট দিতে আপনার কোন আপত্তি থাকে না, টাকার অংকটা ভাল হলেই হয়। আরও বলব? ওহো, মাফ করবেন-মাফ করবেন, আমি যে ঘটক না এটা তো মুখে বললাম। প্রমাণ দেই, মে আই? এই যে আমার আই, ডি।

ডাঃ শাহরিয়ার
মনে হচ্ছে বুকে হাঁপ ধরে যাচ্ছে। হার্টবিটের একটা বিট কি মিস করলেন, মানুষটা যখন তার আই ডি বের করে চোখের সামনে মেলে ধরলেন।
ডাঃ শাহরিয়ার ভয় চেপে বরলেন, ক্কি-কি, চান আমার কাছে?
ওবায়েদ সাহেব তাৎক্ষণিক উত্তর দিলেন না। সময় নিয়ে রিপোর্টটা বের করলেন। এগিয়ে দিয়ে বললেন, এটা ভাল করে দেখুন, চেনা মনে হচ্ছে।
ডাঃ শাহরিয়ার একনজর দেখেই ফেরত দিলেন।
সইটা আপনার?
হ্যাঁ।
হ্যাঁ না, বলুন জ্বী। আমি আপনার বন্ধু না। সইটা আপনার?
ডাঃ শাহরিয়ার থেমে থেমে বললেন, জ্বী।
রিপোর্টটা ঠিক আছে?
ঠিক না থাকলে এটা দেব কেন?
মেয়েটিকে রেপ করা হয়েছিল কিন্তু আপনি স্পষ্ট লিখেছেন, রেপড হয়নি। কিন্তু আপনার চেয়ে কে আর ভাল জানবে যে এটা ভুয়া।
ভুয়া হবে কেন?
চোপ, বেশি ফড়ফড় করবেন না। ভুয়া মানে জানেন না- সারহীন, অসার, শূন্যগর্ভ? মিথ্যা এই রিপোর্টটার জন্য ২২০০ টাকা নিয়েছেন, ভুলে গেছেন?
আমি কোন টাকা নেই নাই।
ওবায়েদ সাহেব অবজ্ঞার হাসি হাসলেন, হুম, না নিলে ভাল।

ডাঃ শাহরিয়ারের
মত মানুষরা ভাঙ্গেন কিন্তু মচকান না। তিনি ভাল করেই জানেন টাকার গায়ে কারও নাম লেখা থাকে না। বললেই প্রমাণ হয়ে যায় না। হ্যাঁ, এটা সত্য, এরা খোঁজ খবর নিয়েই এসেছে। তিনি টাকা নিয়েই এই মিথ্যা রিপোর্টটা দিয়েছিলেন, স্বীকার না করলে কচু হবে!
ওবায়েদ সাহেব খানিকক্ষণ নীরব থেকে বললেন, তাইলে আপনি টাকা নেন নাই?
বললাম তো একবার, না।
হুম, তাইলে নেন নাই?
জ্বী-ই-ই না।
হুমম।

ডাঃ শাহরিয়ারের
আত্মবিশ্বাসের অভাব নেই, সামলে নিয়ে বললেন, অফিসার, আপনি অযথাই আমাকে ফাঁসিয়ে দিতে চাইছেন।
ওবায়েদ সাহেব হেলাফেলা করে হাসলেন, হুমম। ফাঁসিয়ে দেয়া। ভাল বলেছেন, ওয়েল সেইড। দেখুন শাহরিয়ার সাহেব, আপনি এমন সব কর্মকান্ড করে বেড়ান আপনাকে ফাঁসানো আমার জন্য কঠিন কিছু না। জানি-জানি, আপনি কি ভাবছেন, আপনি আইনের ফাঁকতালে অবলীলায় বের হয়ে আসবেন। আর এটা আমার যে জানা নাই এমন না। একটা কথা আছে জানেন তো, কাউকে এক হাত নিচে নামাতে হলে নিজে দুই হাত নিচে নামতে হয়। এটাই হচ্ছে আপনার সুবিধা, আমার অসুবিধা। আপনাকে একহাত নিচে নামিয়ে আমার দু-হাত নিচে নামার সুযোগ নাই! এটা আপনি ঠিকই আঁচ করেছেন, তাই না?

ডাঃ
শাহরিয়ার চুপ করে রইলেন। উত্তর দিলেন না। মনে মনে ভাবলেন, ঠিক ধরেছ ব্যাটা।
ওবায়েদ সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, শাহরিয়ার সাহেব, আমার সময় কম নইলে আমি আপনার চ্যালেজ্ঞ ঠিকই নিতাম। আপনার জীবনটা দুর্বিষহ করে দিতাম। আমি বলি কি, সত্যটা স্বীকার করে ফেলুন, আমি চলে যাব; আপনাকে আর ঘাঁটাব না, আই সয়্যার অন মাই বলস। আপনার নিজস্ব কর্মকান্ড নিয়ে আমার কোন উৎসাহ নেই।
ডাঃ শাহরিয়ারের গলা খানিকটা উঁচু হলো, এক কথা কয়বার বলব!
আপনি যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, যারা রেপ করেছে, শফিক-ফরহাদ, এরা আমার কাস্টডিতে আছে। এরা সব স্বীকার করেছে।
ডাঃ শাহরিয়ার কাঁধ ঝাঁকালেন, একজন বলে দিলেই আমাকে মানতে হবে কেন!
শাহরিয়ার সাহেব, আপনার কাছে জোর অনুরোধ করি, এটা একটা রেপ কেস। এবং রেপড হয়েছে একটা শিশু। প্লিজ, একটু ফেভার করুন। আমি কথা দিচ্ছি, এরপর আপনার কোন প্রসঙ্গ নিয়ে-।
ওবায়েদ সাহেব পুরো কথা শেষ না করেই থেমে গেলেন। সামনে বসা মানুষটার মুখে বিজয়ীর হাসি। ওবায়েদ সাহেবের কাতরতার মানুষটা
অন্য অর্থ বুঝে বসে আছে!

ওবায়েদ সাহেব বললেন, হুমম, তা
শাহরিয়ার সাহেব, আপনার একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে, না?
অজান্তেই
ডাঃ শাহরিয়ারের কপালে ভাঁজ পড়েছে, জানেন যখন জিজ্ঞেস করছেন কেন?
না এমনি। কোন ক্লাশে উঠল, নাইন, রাইট?
হ্যাঁ, তো?
বেশ বেশ। মাশাল্লা।
ডাঃ শাহরিয়ার গলা একধাপ চড়ে গেল, এই বিষয়ে কথা বলার মানে কী!
ওবায়েদ সাহেব পলকহীন দৃষ্টিতে বললেন, না, কোন মানে নাই। আমি ভাবছিলাম আপনার মেয়ের সঙ্গে এই ঘটনাটাই ঘটলে আপনার কেমন লাগত? জাস্ট ভাবছি আর কি- ভাবতে তো আর দোষ নাই, কী বলেন?
হাউ ডেয়ার য়্যু!
তাই মনে হচ্ছে আপনার! কেন, নিজের মেয়েকে নিয়ে এমন আশংকা জাগে না বুঝি?
অফিসার, আপনি কিন্তু লিমিট ক্রস করছেন!
তাই নাকি! কই, আমার তো এমনটা মনে হচ্ছে না।
অফিসার, আপনি এবার আসুন। আমার বিরুদ্ধে যা প্রমাণ করার করুন। পারলে আমাকে কোর্টে তুলুন। লেট সী!
দাঁড়ান-দাঁড়ান, এই মুহূর্তে এখান থেকে যাওয়ার কোন ইচ্ছা নাই আমার। আরে না, কোর্ট-ফোর্টে যাওয়া নিয়ে আমার কোন ইচ্ছা নাই।

এইবার ওবায়েদ সাহেব ওসি জুনাব আলীর দিকে ফিরে বললেন, ইয়ে, জুনাব আলি, আপনার জানামতে কোন দাগী আসামী বা বদমায়েশ ক্রিমিনাল আছে?
জুনাব আলি এই মানুষটার কথার ধারা খানিকটা আঁচ করতে পারেন। উৎসাহে বললেন, তা খুঁজে বের করা যাবে, সার।
শিওর?
জ্বী সার।
কনফার্ম করেন, নইলে বাইরে থেকে আমাকে আবার পাঠাতে হবে।
না সার, সমস্যা হবে না।

ওবায়েদ সাহেব জুনাব আলির সঙ্গে কথা চালিয়ে যাচ্ছেন
ডাঃ শাহরিয়ারকে উপেক্ষা করে।
জুনাব আলি, আপনি এমন একজন ঠিক করুন। ওকে আমরা এই কাজের বিনিময়ে সব ধরনের ছাড় দেব।
সার, এমন একজন না, কয়েকজনকেই পাওয়া যাবে। আপনি মাথায় হাত রাখলে এরা হাসতে হাসতে কাজটা করে দেবে।
আরে না জুনাব আলি, আমি তো ধরাছোঁয়ায় থাকব না। যা করার আপনিই করবেন। অবশ্য আমার সব সাপোর্ট পাবেন, কথা দিলাম।

ডাঃ শাহরিয়ার
মানুষটা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, ভয়টাকে আটকাতে। পারছেন না। এই মানুষটার হেলাফেলা ভঙ্গি ভয় ধরাবার জন্য যথেষ্ট। তিনি লক্ষ করলেন এরা তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। একাগ্রমনে শলা করছে। সত্যি সত্যি কি এরা এটা করবে, নাকি তাকে ভয় দেখাচ্ছে।
জুনাব আলি, তাইলে আপনি কাজ শুরু করে দেন। এস, পিকে শুধু এটা আমি বলে দেব, আপনার যেন কোন সমস্যা না হয়। ভাল কথা, যাকে দিয়ে কাজটা করাবেন সে আবার স্বীকার করে ঝামেলা করবে না তো?
না সার, টাইট দিয়ে দেব।
উঁহুঁ, জুনাব আলি, এই বিষয়টা কিন্তু হেলাফেলার বিষয় না। ভাল হয় ওই পরে বদমায়েশটাও মারা গেলে। ইয়ে, বুঝতে পারছেন তো?
জ্বী সার, আপনার এই পরামর্শটা মনে ধরেছে। এটাই ভাল হবে। রিস্ক কম।
আমারও তাই মনে হয়।
সার, আপনি আমার উপর ছেড়ে দেন। দেখেন আমি কিভাবে ব্যাপারটা সামলাই।
গুড।
সার, পুরো ঘটনাটার ভিডিও করে এক কপি পাঠিয়ে দেব?
না জুনাব আলি, নেহায়েৎ বোকামি হবে। তাছাড়া এটার আদৌ প্রয়োজন নাই। কাজটা হয়ে গেলেই হয়। আমি কেবল দেখতে চাই ডাঃ সাহেব কার কাছে গিয়ে তার মেয়ের বিচারটা চান।

ডাঃ শাহরিয়ার
আর পারলেন না। দু-হাতে মুখ ঢাকলেন। অস্ফুট স্বরে বললেন, স্টপ ইট, প্লিজ স্টপ ইট।
ওবায়েদ সাহেব এবং জুনাব আলি চুপ করে গেলেন।
ডাঃ শাহরিয়ারকে সামলে নেয়ার সুযোগ দিচ্ছেন।
শাহরিয়ার সাহেব ভাঙ্গা গলায় বললেন, বলুন কি করতে হবে আমাকে?
আপনার এই রিপোর্টটা ভুল।
জ্বী।
মেয়েটা রেপড হয়েছিল এর আলামত পাওয়া গিয়েছিল?
জ্বী।
আপনি এখন যেটা করবেন নতুন করে রিপোর্টটা লেখবেন। যা ঘটেছিল তাই লিখবেন। কি লিখবেন না?
জ্বী সার।
গুড।
 
কিন্তু ফরম তো হাসপাতালে।
ওবায়েদ সাহেব এবার অমায়িক হাসি হাসলেন, ও নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। ফরম আমরা সাথে করেই নিয়ে এসেছি।
ডাঃ শাহরিয়ার এক্ষণ পূর্ণদৃষ্টিতে মানুষটাকে দেখলেন। এতটা বিস্মিত তিনি জীবনে খুব কমই হয়েছেন। মানুষটা প্রস্তুতি নিয়েই ডাঃ শাহরিয়ার খসখস করে নতুন করে লিখে দিলেন।
ওবায়েদ সাহেব পলকে চোখ বুলিয়ে উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বললেন,
শাহরিয়ার সাহেব, কথা দিয়েছি যখন আজকের পর আমাকে আপনি আর দেখবেন না। কিন্তু এই প্রার্থনাও করি, এমন একটা দিন যেন আপনার জীবদ্দশায় আপনাকে কখনই দেখতে না হয়। আপনার মেয়েকে আমার শুভেচ্ছা দিয়েন। বাই।" ('খোদেজা')

*উক্ত রিপোর্টটির সঙ্গে 'খোদেজা'- এই ফিকশনের কোনও যোগসূত্র নাই। সাত বছরের খোদেজা নামের অভাগা মেয়েটির সঙ্গে প্রায় একই ধরনের শারীরিক অন্যায় কিন্তু আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল। সে ভিন্ন প্রেক্ষাপট।

Sunday, September 27, 2009

হাজামের হাতে সার্জনের ছুরি!

অন-লাইনে লেখালেখির সুবাদে আমার সঙ্গে অনেকেই কঠিন অমত পোষণ করতেন যে বিষয়টি নিয়ে, সেটা হচ্ছে গালাগালি। অল্প প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে গালির ফোয়ারা ছুটিয়ে দেয়া। এটা আমার কঠিন অপছন্দের। আমার স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, এটা লেখার-ভাবনার মান কমিয়ে দেয়।

কিন্তু উপন্যাসে গ্রামের অশিক্ষিত একটা চরিত্র, সে তো আর প্রতি শ্বাসে আসতে আজ্ঞা হোক, বসতে আজ্ঞা হোক বলবে না। নিম্নবিত্ত মহিলাদের দেখেছি অবলীলায় তার মেয়েকে 'হতিন' (সতীন) বলে অহরহ গাল দিতে।
অর্থটা ভাবলেই গা গুলায়, রোম দাড়িয়েঁ যায়! মেয়েকে এই গাল দেয়ার অর্থ কী কুৎসিত-কী ভয়াবহ-কী জঘন্য এটা নিয়ে মাথা ঘামাবার আদৌ প্রয়োজন তাদের নেই।

খোদেজা নামের উপন্যাসের অংশবিশেষ একজনের অনুরোধে আমার নিজের সাইটে পোস্ট করেছিলাম। ওই উপন্যাসের চরিত্রের প্রয়োজনে, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু গালি এসেছে।


খোদেজা উপন্যাসটির অংশবিশেষ দাঁড়ি-কমাসহ একজন যৌবনযাত্রা নামের সাইটে কপি-পেস্ট করে দিয়েছিলেন যা আমাকে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ করেছিল। এই নিয়ে একটা লেখা দিলে যৌবনযাত্রার বাঘ মামা (অনুমান করি, তিনি ওই সাইটের একজন কর্তৃপক্ষ গোছের কেউ একজন) দু:খপ্রকাশ করেন। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি, আবারও করি।

যে-কোন প্রয়োজনে একটা লেখার লিংক দেয়া চলে কিন্তু বিনা অনুমতিতে, না জানিয়ে হুবহু কপি-পেস্ট করাটা অপরাধ। অবশ্য এদের আর দোষ দেই কেমন করে আমাদের দেশে এখনও প্রথম আলোর মত প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা একটা লেখা ছেপে দিয়ে দয়া করে লিখে দেয় 'ওয়েব সাইট অবলম্বনে' বা 'ওয়েব সাইট থেকে'। যেন ওয়েবসাইটের তথ্যগুলো গণিমতের মাল-বহুভোগ্যা। পত্রিকা বা ছাপার অক্ষরে আমরা যা পড়ি তাই শিখি, শিখছিও তাই।


"শফিক নিমিষেই খোদেজাকে ছেড়ে নিরাপদ দূরুত্বে সরে এসে পশুর আক্রোশে ড্রাইভারকে গাল দিচ্ছে, ****নির পোলা, *** বেডির পোলা...।"
যৌবনযাত্রায় ওই লেখাটা পড়তে গিয়ে মজার এই বিষয়টা লক্ষ করলাম। আমার লেখাটার সবটুকুই হুবহু কপি-পেস্ট করা হয়েছে কিন্তু এই প্যারায় এসে গালিগুলো সেন্সর করা হয়েছে।

খোদেজা উপন্যাসের এখানে গালিগুলো না দেয়ার অর্থ হচ্ছে বিকলাঙ্গ একটা লেখা। শফিক নামের যে মানুষটা, এই গালি দিচ্ছে সে হচ্ছে গ্রামের বখা একটা ছেলে, ওসময় উদগ্র কামার্ত একজন মানুষ, পুরাপুরি বশে নিয়ে আসা শিকার (খোদেজা নামের শিশুটি) চোখের সামনে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তার আক্রোশ আমি মনশ্চক্ষুতে দেখতে পাই। এই মানুষটার পক্ষে ওই মুহূর্তে কাউকে মেরে ফেলা বিচিত্র কিছু না, যা সে পরবর্তি সময়ে করেছে। সে এবং তার সঙ্গিরা মেয়েটির চিৎকার থামাবার জন্য তার মুখে মুঠো মুঠো বালি গুঁজে দিয়েছে।

তো, এমন পরিস্থিতিতে শিকার যখন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, এখানে আমি যেমন আশা করি না তেমনি পাঠকের আশা করাটাও সমীচীন হবে না যে, চরিত্রটি সুর করে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইবে, যেতে নাহি দেব তবুও যেতে দিতে হয় পে-এ-এ-এ। এটা দেখানো আমার মত অলেখক, ৩ টাকা দামের কলমবাজের পক্ষে সম্ভব না। আমাদের দেশের বড় মাপের লেখক স্যারদের জন্য
না-হয় এটা তোলা থাকুক।
ওয়াল্লা, এঁরা কারণে-অকারণে যে কোন চরিত্রর মুখে রবিদাদার কোন গান-কবিতা বা উঁচুমার্গের কোন বাতচিত বসিয়ে দেন। এটা কেন করেন কে জানে- তিনি নিজে পছন্দ করেন বলে? একজন মাতালের ন্যায় যার রোদে মদ গিলতে হয়, বৃষ্টিতেও!

ওই সাইটে গালিগুলোকে সেন্সর করা দেখে আমি হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারছি নাপাশাপাশি এই বাসনাটাও তীব্র হয়, বড় সাধ জাগে, অপারেশন থিয়েটারে হাজাম-নাপিতের হাতে সার্জনের ছুরি তুলে দিলে কেমন হয়? বাস্তবে দেখলাম না তাতে কী অন্তত এটা দেখে দুধের সাধ ঘোলে তো মিটল!

Monday, August 31, 2009

খোদেজা: ৫

নিশি বেরিয়ে দেখল ছেলেটা গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছেকেমন গোল হয়ে শুয়েছেছেলেটা অদ্ভুতএর শোয়ার খাট আছে কিন্তু এর নাকি মাটিতে শুয়েই আরামআচ্ছা, সোহাগের ভাল নামটা যেন কি? কখনও সম্ভবত জিজ্ঞেস করা হয়নিসোহাগের সঙ্গে নিশির কথা হয় খুব কমনিশির মন ভাল থাকলে অবশ্য আলাদা কথা, তখন নিশি নিজ থেকেই একগাদা কথা বলে

নিশিকে সোহাগের ঘুম ভাঙ্গাতে বেগ পেতে হলোসোহাগ নিশিকে দেখে চোখ মেলল, ধড়মড় করে উঠে বসল

আফা, রাগ কইরেন না, বইয়া বইয়া ঘুমাই গেছিলামঅক্ষণই কাম শ্যাষ কইরা ফালামু

কাজ নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না, ইচ্ছা করলে ঘুমাঘুমাবি?

না গো আফা, আর ঘুমাইতে ইচ্ছা করতাছে না

নিশি ঝোকের মাথায় বলে বসল, বাড়িতে যাবি রে, সোহাগ?

সোহাগ চোখ বড় বড় করে বলল, হেছা আফাআল্লার কিরা, মিছা কইতাছেন না

নিশির বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে ঘোর কেটে গেলবাড়িতে সোহাগকে নিয়ে যাবেটা কে? জাবীরকে বললে ও ঠিক ঝাঁঝিয়ে উঠবে: তোমার কোন কান্ডজ্ঞান নাই নাকি!

নিশি হয়তো জটিলতা এড়াবার জন্য বলবে: আহা, একটা কথা বলেছি, না করলে না করবে, এ নিয়ে হইচই করার তো কিছু নাই! ছেলেটা কতদিন হলো বাড়িতে যায় নাও খুব মন খারাপ করে থাকে

হইচই-হইচইহোয়াট ডু য়্যু মীন বাই হইচই! একটা কথা বুঝে, না বুঝে বলে আমার মাথায় একটা বোঝা চাপিয়ে দিলেএমনিতেই আমার যন্ত্রণার শেষ নাই

তখন নিশির কষ্টের নিঃশ্বাস ফেলা ব্যতীত আর কোন উপায় থাকবে নানিশি প্রায়শ ভাবে, আচ্ছা এই মানুষটার সঙ্গে ও ঝুলে আছে কিভাবে? মানুষটাকে ছেড়ে যাবে ভাবলেই বুকের গহীন থেকে অজানা এক কষ্ট পাক খেয়ে উঠে কেন? এই জটিল প্রশ্নের উত্তর নিশির কি কোন দিনই জানা হবে না? নিশির কি এ দ্বিধা থেকে কোন মুক্তি নেই

নিশির বিব্রত ভঙ্গি, সোহাগ, দেখব তোর ভাইজানের সঙ্গে কথা বলে

সোহাগ মিইয়ে যায়খানিকক্ষণ কি যেন আনমনে ভেবে বলে, আফা, আমি এখলা এখলা চইলা যামু, কুনু সমস্যা হইব নারাস্তাই আমারে টাইন্যা লয়া যাইব

নিশি আঁতকে উঠে, যাহ, কি বলিস, মাথা খারাপ, তুই একলা একলা যাবি কেমন করে

কুনু সমুস্যা হইব না, আফাচোক্কের নিমিষে যামু গা

নিশি আলগা গাম্ভীর্য এনে বলল, এমন পাগলামির কথা আর যেন না শুনি, আমি তোর ভাইজানের সঙ্গে কথা বলবসে কোন একটা ব্যবস্থা করবেহ্যা রে, সোহাগ, তোর লেখাপড়া কোদ্দুর হল?

সোহাগের অক্ষরপরিচয় আগে থেকেই ছিলনিশি কোন কোন দিন ওকে নিয়ে পড়তএকদিন বই-খাতা এনে দিল, ক-দিন সোহাগ পালিয়ে পালিয়ে থাকলনিরূপায় হয়ে একসময় ভাঙ্গ ভাঙ্গা বানান করে পড়া শুরু করলবিচিত্র সব ছড়া লেখা শুরু করল


পালকি চলে, রবিন্দ্রনার ঠকুর

"পালকি চলে

পালকি চলে

গান তরে

আগুন জলে

ছদু গায়ে

আদুল গায়ে

জাচে তারা

রদি সারে

মনা মদু

চখ মদু..."।


আরেকদিন লিখল:

"ফালাইননা খারাপ

ফালাইননা বানর

ফালাইননা দুষ্টামি করে

ফালাইননাকে লাতি মারব

ফালাইননাকে ঠাওয়া মেরে ফেলে দিব

ফালাইননা একটা মেতর, সে গু সাপ করে"


নিশি হাসি গোপন করে বলেছিল: সোহাগ, ফালাইন্যা কে রে?

সোহাগ কোন উত্তর দেয়নিমুখ নিচু করে কেবল হেসেছিলফালাইন্যা কি ওর প্রিয় বন্ধুর নাম? নিশি নাছোড়বান্দা: বল না সোহাগ, ফালাইন্যা কি তোর প্রিয় বন্ধু?

সোহাগ বলেছিল: ফ্রিয় কি, আফা?

ধুত, ফ্রিয় না, প্রিয়

সোহাগের মুখ নিচু হতে হতে গিয়ে হাঁটুতে ঠেকত,

ফালাইন্যা আবার কি নাম রে?

বুঝেন নাই আফা, ফালাইননার মাইনে হইল গিয়া যারে সবাই ফালাইয়া দেয়

কি বলিস, বুঝিয়ে বল

হের আগে হের ভাই ভইন হক্কলে মইরা যাইত তোএর লিগ্যা হের নাম রাখছিল ফালাইননা

রাখলে কি হয়?

অমা, জানেন না বুজি, ফালাইননা হইল ফালাইননা, হেরে তো আজরাইলও নেয় নাআজরাইল না নিলে মরব কেমনে? আফা, আফনে দেহি কুছতা জানেন না

এক্ষণ সোহাগ মুখ দিয়ে বিচিত্র শব্দ করে ছাদের টিকটিকি তাড়াবার চেষ্টা করছেবিচিত্র শব্দটা করতে করতেই বলল, আফা-আফা গো, দেখছেন নি, এইডা কেমুন লাফলালাফলি-ঝাপলাঝাপলি করতাছে?

নিশি অনেক কষ্টে হাসি গোপন করল, সোহাগ, এতদিন এখানে থেকেও তুই ভাষাটা বদলাতে পারলি না!

সোহাগ মুখ ভরে হাসল, আফা, আপনেগো কথা কইয়া শান্তি নাইফাপড় লাগে

সোহাগ, তোকে যে ছড়াগুলো শিখিয়েছিলাম, মনে আছে না, নাকি ভুলে গেছিস?

সোহাগের এই পরীক্ষা টাইপের বিষয়গুলো ভাল লাগে নাসে কথা ঘুরাবার জন্য বলল, আফা, আমাগো গেরাম দেশের একটা ছড়া কই?

বল

"আতা গাছের মাথা নাই

মাথার মইদ্যে চুল নাই

চুলের মইদ্যে উকুন নাই

উকুনের মরন নাই

মরলে কিন্তু বাছন নাই"


নিশির এবার হাসি চাপা সম্ভব হলো না

আফা, সোন্দর না?

হুঁ, সুন্দরকিন্তু তুই দেখি দুনিয়ার সব আজগুবি কথা বলিস

সোহাগের মন খারাপ হয়ে গেলসে স্পষ্ট বুঝতে পারছে আপা তার কথা খুব একটা পছন্দ করেনিআপা এমন করলে তার বুকটা ফাঁকা হয়ে যায়!

Saturday, August 1, 2009

খোদেজা: ৪

নিশির প্রচন্ড ক্ষুধা বোধ হচ্ছে। এতটা সময় পেরিয়ে গেছে, আশ্চর্য!
নিশি ডাকল, সোহাগ, এই সোহাগ।
উত্তর নেই। আশ্চর্য, গেল কই! ও তো কখনও না বলে ঘরের বাইরে যায় না। অনিচ্ছায় উঠে সোহাগকে পেল বারান্দার গ্রিল ধরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। চোখ আকাশে। কতক্ষণ ধরে এ এভাবে দাঁড়িয়ে আছে? এইটুকুন ছেলে কী দেখে আকাশে? ওর দাঁড়াবার ভঙ্গিতে কি যেন একটা আছে, বুকটা কেমন করে উঠে।

কি করিস, সোহাগ?
কিসছু না, আপা।
এভাবে কি দেখিস?
সোহাগ উত্তর দিল না। চোখ কেমন ভেজা। এ কাঁদছিল নাকি?
নিশি কোমলস্বরে বলল, সোহাগ, সারাদিন জানালা দিয়া কি দেখিস?
কিসছু না আফা, এমনই।
আহা, বল না, বলতে তো দোষ নাই। আমার কাছে তোর লজ্জা কী! বাড়ির কথা মনে পড়ছে?
সোহাগ কেঁদে না ফেলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে, ন-না। তয় আমার ভইনের কথা মনে পড়তাছে। আফা, ফাপর লাগে।
ক-ক্কি, কি বললি বুঝলাম না। ফাপর কি!
মন পুড়ে আফা। কেমুন কেমুন লাগে। বুঝাইতে পারুম না গো, আফা।
সেটা বল, মন খারাপ লাগে। কেন রে?
আমার গেরামের কথা মনে অয়, আমার ভইনডা-।
সোহাগ, তোর বোন তোর চেয়ে বড়ো, না ছোট?
ছোড আফা।
তোর বোনের বয়স কত রে?
হেইডা তো জানি না। বড় ঢলডার সুময় হইছিল।
কি কস, বুঝি না। ঢল কি।
ফানি গো আফা, ফানি। যেইদিকে দুই চোক যায় হেই দিকে ফানি।
ফানি নারে গাধা, বল পানি।
শুদ্দু ভাষা কইতে ফারি না, আফা। ফাপড় লাগে।
ভালা মুসিবত। ইয়ে তোর বোন তোর থেকে কত ছোট রে?
তা ক্যামনে কই! মইদ্যে এক ভাই মইরা গেল। তয়, আমরা পিট্টাপিট্টির মতন আছিলাম। আফা, হের কতা মনে হইলে বুকে ফাপড় লাগে। দম আটকায়া আসে।

নিশি অনুমান করল, সোহাগের বয়স আট-দশ হলে এর বোনের বয়স ছয়-সাত হবে। গ্রামে তো লম্বা সময় গ্যাপ দিয়ে বাচ্চা নেয়ার কথা কেউ ভাবে না। ফি বছর বাচ্চা হয়।
তোর বোনের নাম কি, সোহাগ?
খোদেজা। আফা, হে না এমুন পাগলি, হি হি হি, হে হাসের লগে কথা কয়।
কি বলিস!
হ আফা। হের মেলা হাস। আফা, আমি নিজের চোককে দেখছি ছিনি কয়া ডাক দিলে ল্যাংড়া হাসটা আগাইয়া আসে। খোদেজারে ঠুক্কুর দেয়।
চিনি কি!
আফা, নাম গো, হাসটা নাম। হের একেটডা হাসের একেক নাম। ছিনি, লবন, মিঠাই।
বলিস কী!
মিছা কইলে আমারে য্যান বক্কিলা খায়।
বক্কিলা কি?
সোহাগ ভাবনায় তলিয়ে গিয়েছিল, বক্কিলা শব্দটার অর্থ এর জানা নাই। কে জানে, ভয়ংকর কিছু একটা হবে। যেটা নাম বলে সোহাগের বয়সের শিশুরা কঠিন শপথ করে। অজানা ভয়ে থরথর করে কাঁপে!
নিশির বুকের কোন এক গহীন থেকে একটা বেদনা পাক খেয়ে উঠে। এই শিশুটির অজানা বেদনাগুলো আজ বড়ো স্পষ্ট হয়ে উঠে। নিশিরা সময়মতো বাচ্চা নিলে কে জানে এর বয়সী একটা শিশু থাকত তাদের!

নিশি কথা ঘুরাবার জন্য বলল, তুই ভাত খেয়ে নিয়েছিস তো?
ভুক নাই।
আরে পাগল, বলিস কী! এত বেলা হলো তুই এখনও খাস নাই কেন! আমারও ক্ষিধা লেগেছে, আয় একসাথে খাই।
আপা, ভাইজান আইব না?
নিশি মনখারাপ করা শ্বাস ফেলল, না। কেন যেন নিশির এক্ষণ পা ছড়িয়ে খুব করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। সোহাগের জন্য নাকি নিজের জন্য, কে জানে!

Friday, June 5, 2009

রিপোর্টিং এবং ফিকশন!

'মা-মা, অ মা, দেখো তোমায় কেমন ছুঁয়ে দিচ্ছি'।
হাসিখুশি মা-টার
মনটা আজ কী কারণে যেন ভারী বিষণ্ন। অন্য সময় খোকার এই চক্রাকারে ঘুরপাক খাওয়া এবং ছুঁয়ে দেয়ার খেলাটা কী উপভোগ্যই না মনে হত। কিন্তু আজ মোটেও ভাল লাগছে না, বিরক্ত লাগছে।

মা-র বুকটা কেমন ভার হয়ে আছে। আহ, খোকাটা এমন অবুঝ হয়েছে কেন! খোকারই বা কি দোষ, কীই বা বয়স ওর, ক-দিনইবা হলো এই পৃথিবীর মুখ দেখেছে! মা কঠিন কিছু কথা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। প্রাণপণ চেষ্টায় গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললেন, 'বাবু, যাও, অন্যদের সাথে গিয়ে খেলা করো'। 
খোকা চক্রাকারে ঘুরপাক থামিয়ে ঝলমলে মুখে বলল, 'উহুঁ, আমার যে তোমার সাথে খেলতেই ভাল লাগে, তুমি যে আমার লক্ষী মামইন্যা'। খোকা এবার তার স্বরচিত ছড়া ক্রমাগত সুর করে বলতে থাকল, 'মামইন্না-মামইন্না, পিঁড়ি থেকে নামইন্না'।
 
খোকা আজকাল বড়ো ছড়াকার হয়েছে। তার এইসব স্বরচিত ছড়ার কোন আগামাথা নাই। অন্য সময় হলে মা হাঁ করে খোকার এইসব ছড়া শোনেন। আজ মোটেও এসব টানছে না। মা রাগ-রাগ গলায় বললেন, 'বাবু, তোমাকে একবার একটা কথা বললে কানে যায় না, বললাম না অন্যদের সঙ্গে গিয়ে খেলা করো। আর শোনো, ঘসাঘসি করবে না, বিরক্ত লাগছে'।
খোকার এতক্ষণে হুঁশ হলো। মার বিবর্ণ মুখটা ভাল করে লক্ষ করল। আহা-আহা, মার কীসের কষ্ট! ইশ, কি করলে মার কষ্ট কমে এটা জানলে বেশ হতো কিন্তু খোকা তো এটা জানেই না ছাই! কথা ঘুরাবার জন্য বলল, 'মা, দৈত্যরা তো আমাদের ধরতে পারলে মেরে খেয়ে ফেলবে, না'?
মা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, 'হুঁ'।
খোকা শিউরে উঠে বলল, 'ইশ, দৈত্যরা কী নিষ্ঠুর, না মা?
মা বললেন, 'হুঁ-ম'।
'মা, আমাকে ধরলে পারলেও খেয়ে ফেলবে'?
 
মা হাহাকার করে উঠলেন, 'বালাই ষাট, তোকে খাওয়ার আগে যেন আমাকে খায়। খোকা, আর কক্ষণও এমন কথা মুখেও আনবি না। এইটুকুন ছেলে, কীসব কথা! খোকা, বুকে থুতু দে'। 
'আচ্ছা মা, আমাদের তো দৈত্যরা ধরবে না, না? আমাদের এই জায়গাটা তো পবিত্র, তাই না? আমরা এখানে থাকলে দৈত্যরা নাকি আমাদেরকে খেতেই পারবে না'?
মা খোকার চোখে চোখ রেখে বললেন, 'হুঁ'।
 
'আমাদেরকে খেলে নাকি দৈত্যরা নিজেরাই মরে যাবে? সত্যি নাকি, মা'?
'হা, সত্যি'।

খোকা এবার লাফিয়ে উঠল, 'কী মজা-কী মজা। দৈত্যরা আমাদের খেতে পারবে না-পারবে না'। খোকা এবার কথা ঘুরাবার জন্য বলল, 'মা, তোমার কি মন খারাপ'?
মা বললেন, হুঁ-উ।
'বেশি খারাপ'?
'হুঁ',
'তোমায় একটা ছড়া বলি'?
'না। যাও গিয়ে খেলা করো গিয়ে'।

খোকা চলে যাচ্ছে। দেখো দেখি ছেলেটার কান্ড, পাগলুটা কেমন বারবার ফিরে তাকাচ্ছে, এই বুঝি মা পিছু ডাকল। খোকাটা একদম একটা পাগলু হয়েছে! খোকা একসময় চোখের আড়াল হয়ে গেল। মা খোকাকে এটা বলতে পারেননি, তাদের মাথার উপর বিপদ, ভয়াবহ বিপদ। ইশ, খোকা যদি বুঝত বড়দের কত সমস্যা, সমস্যার কূলকিনারা নাই রে!
এখানে থাকলে দৈত্য নামের মানুষরা তাদের খেতে পারবে না এটা সত্য কিন্তু খেতে পারবে না বলেই তাদের সবাইকে মেরে ফেলার জন্য বুদ্ধি করা হচ্ছে। কালই শুনছিলেন, দৈত্যরা বিচিত্র ভাষায় কথা বলছিল, শলা করছিল: সবাইকে মেরে ফেল, সব্বাইকে। ওষুধ ছড়িয়ে দাও। সবাইকে মেরে ফেল, একজনও যেন না বাঁচতে পারে।
 
এক্ষণ মার বুকে কেমন চাপ চাপ ব্যথা। দৃষ্টি কেমন অস্বচ্ছ হয়ে আসছে। এটা কী চোখের ভুল, পানির রঙ কী বদলে গেছে খানিকটা? এমন হচ্ছে কেন, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে কেন? শ্বাস নিতে পারছে না। মনে হচ্ছে কলজেটা মুখে চলে এসেছে! মা নিমিষেই বুঝে ফেললেন, বোঝার আর বাকি রইল না। তাদেরকে মেরে ফেলা হচ্ছে। চারদিক থেকে অন্যরা ভুসভুস করে ভেসে উঠছে, পেট উল্টে যাচ্ছে। কেউ কেউ মুখ হাঁ করে আটকে রাখা দম ফেলার চেষ্টা করছে, আপ্রাণ চেষ্টায় নীচে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে, লাভ হচ্ছে না।
 
অভিজ্ঞ মা-টা এটা বিলক্ষণ জানেন বিষ পানিতে সমান ভাবে মিশতে প্রচুর সময় লাগে আর কিছু ফাঁকা জায়গা থাকে যেখানে যেতে পারলে বাঁচার সম্ভাবনা বেড়ে যায় কিন্তু মা-টা এসব নিয়ে ভাবছেন না। কেবল পাগলের মতো তার সন্তানকে খোঁজার চেষ্টা করছেন। কোথায় পাবেন তার সন্তানকে? চারদিকে আর্তনাদ, হাহাকার। মা বুঝতে পারছেন ক্রমশ তার সময় ফুরিয়ে আসছে।
তার মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল, একই শব্দ বারবার আউড়ে যাচ্ছেন: খোকা-খোকা, অ খোকা, অ আমার পাগলু, ফিরে আয়-ফিরে আয় সোনা, তোর মাথার দিব্যি আর কক্ষণও তোকে যেতে বলব না, কক্ষণও না। একবার আয়- কেবল একবার আয়- আয় বাপ, একটি বারের জন্য আয়...!
 
*এটা একটা পুরনো লেখা কিন্তু আমার অসম্ভব পছন্দের। এই ফিকশন-লেখার উৎস যে রিপোর্ট বা খবরটা সেটা হচ্ছে, 'ঢাকা ওয়াসার পয়োপরিশোধন কেন্দ্রের লেগুনের সব মাছ বিষ প্রয়োগে মেরে ফেলা হয়। ভেসে ওঠে কয়েক টন মৃত মাছ'।

এই খবরটা যখন আমি পড়ি তখন আমার চশমার কাঁচ ঝাপসা, বুক ভেঙ্গে আসছিল। গলায় কী যেন দলা পাকাচ্ছিল। কেন? এর উত্তর আমার কাছে নাই। আমরা কী মাছ খাই না? খাই। আমি কী মাছ খাই না? খাই। তাহলে? আমি জানি না-আমি জানি না!
বুঝলাম উপায় ছিল না কিন্তু এভাবে মেরে ফেলাটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। আমার কেবল মনে হচ্ছিল জ্ঞানে-বুদ্ধিতে উন্নত জাতি প্রায় একই ভঙ্গিতে আমাদের মত অনুন্নত জাতিকে নির্বিকার ভঙ্গিতে মেরে ফেলে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোই যদি ঠিক করে এই গ্রহ থেকে বাংলাদেশের নামটা মুছে ফেলবে, সম্ভব। এই মাছের মতই এরা মেরেছে ইরাকিদের, ফিলিস্তানিদের...।

**অন্যত্র এই লেখাটাই পড়ে আমার এক সুহৃদ চটে লাল, কী চটাচটি! তিনি মুখে আলাদা কাঠিন্য এনে বলেছিলেন, হুম, মাছ। শোকগাথা, হুম। মাছের জন্য এলিজি, হুম। তোমার মধ্যে সমস্যা আছে, ভয়াবহ সমস্যা।
এ আমি বিলক্ষণ জানি আমি সমস্যার 
চলমান ট্রাক কিন্তু আমার এই কষ্টটার মধ্যে কোন খাদ নেই। আমি দুঃখ লুকিয়ে বলেছিলাম, কেমন?

তখন তিনি বিস্তর উদাহরণ দিলেন, আমি কখন কার সঙ্গে পোকার ন্যায় আচরণ করেছি। কার মৃত্যুসংবাদ শুনে বলেছি, অ- আচ্ছা! তিনি সদুপদেশও দিলেন, ভাল মানসিক রোগের ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। সোজা বাংলায় পাগল...!
 
আসলে জানি না, জানি না আমি। এই তীব্র কষ্ট-খারাপলাগার উৎস কোন নিতল থেকে উঠে আসে? এটা আমার জানা নাই- জানা থাকলে ভাল হত। আমি নিজেকেই নিজে চিনি না। মস্তিষ্ক আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে, আমি না! এ তো আমি আর আমার মস্তিষ্কের মধ্যেকার বাতচিত। আহা, এখানে মস্তিষ্কের ডাক্তারের কী কাজ, ছাই!
তবুও এই বিষয়ে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছিলাম। কী কারণে জানি না তিনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন। একদা তিনি আমাকে এই বলে খারিজ করে দিলেন খুব বেশিদিন আপনার চিকিৎসা করলে আমি নিজেই আপনার মত হয়ে যাব। আমার 'ফ্রিডম' বইয়ে এর অনেকটাই চলে এসেছিল। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ, এখানে এই আলোচনার খুব একটা গুরুত্ব নেই।
... ... ...
২৮.০৭২০২০
আমার মত সাধারণ মানুষ মাছের জন্য এলিজি লেখে কলম দিয়ে কিন্তু এঁরা লেখেন হৃদয় দিয়ে:
 

Monday, April 13, 2009

'খোদেজা'র কঠিন সমালোচনা এবং আমার স্বল্প উত্তর

এই সমালোচনাটা করেছেন রাসেল পারভেজ (তাঁর স্ক্রীণ-নেমটা এখানে শেয়ার করার প্রয়োজন বোধ করছি না)। একটা ওয়েব সাইটে খোদেজা নিয়ে সমালোচনা লিখেছিলেন। এর উত্তর লিখব লিখব করে আর লেখা হয়নি। একটা লেখা লিখে ফেলাটা যতটা সহজ কিন্তু এর কোন একটা অংশের ব্যাখ্যা করা, বা সমালোচনার পিঠে আলোচনা করা; আমার জন্য এরচেয়ে কঠিন কিছু নেই! তদুপরি সবিরাম চেষ্টাটা থাকেই!
ওই সাইটে রাসেল পারভেজ হামেশাই 'ডেঞ্জার জোনে' থাকেন। কখন তার সমস্ত লেখালেখিসহ গোটা ব্লগ উধাও হয়ে যায় এই ভাবনায় সমালোচনাটার অংশবিশেষ এখানে দিয়ে দিলাম।

গোটা ব্লগ উধাও করে দেয়া- ওখানে নাকি এটার চল আছে! যে-দেশের যে চল! এইজন্য ব্লগারদের মিটিং-মিছিল পর্যন্ত করতে হয়! এই ভাবনাটা আমার কাছে কেবল অমানবিকই মনে হয় না, অসুস্থ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ঠ। অন্যদের কথা জানি না কিন্তু আমার কাছে আমার লেখা সন্তানসম। আমার সন্তানকে আমি স্পর্শ করতে পারব না এমন কোন আইনকে আমি মানি না, স্বীকার করি না।)

রাসেল পারভেজ তাঁর সমালোচনায় লিখেছেন:
আমরা সাহিত্যের অপমৃত্যু দেখি এ রকম আত্মঘাতি প্রবনতায়। খোদেজা উপন্যাসটির পেছনের পাতায় খোদেজা উপন্যাসের যেই কাঠামোর তথ্য বিদ্যমান ভেতরে প্রবেশ করে সেই কাঠামো খুঁজে পাওয়া যায় না। লেখকের অসাবধানতা কিংবা অযোগ্যতা কিংবা প্রকাশকের কূণ্ঠা কোনটাকে দায়ী করবো ভেবে পাই না আমি।

সামান্য কথায় ঘটনাটা বলতে গেলে লেখকের সবিনয় নিবেদন থেকে তুলে দিতে হয় এ উপন্যাস লেখার পশ্চাত কথনটুকু। খোদেজা নামের এক শিশু ধর্ষিত হয় বাংলাদেশের কোনো এক গ্রামে, তার প্রতি এই নির্মমতার কোনো দ্বিতীয় উদাহরন নেই। সম্প্রতি মগবাজারে ২জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের ধর্ষন করবার পরে হত্যা করা হয়েছে তবে তাদের ধর্ষণ এতটা নির্বিকার নির্মম ধর্ষণ না। তাকে হত্যা করে ঘাতকেরা তার জানাজায় অংশ নেয়। এই মর্মবেদনা লিখে রাখবার কারণেই এই উপন্যাস লিখবার তাড়না তৈরি হয় লেখকের ভেতরে।

উপন্যাসটি একটা পরিনতিতে পৌছালেও আমার কাছে অসম্পূর্ণ এবং ফাঁকিবাজির কাজ মনে হয়। প্রথমত উপন্যাসে ঢুকতে না পারার অক্ষমতা। মূলত এমন সব চরিত্র নিয়ে নাড়াচাড়া হচ্ছে এখানে যাদের সাথে খোদেজার সংশ্লিষ্ঠতা সামান্য, এবং এই চরিত্রগুলো কখনই খোদেজার সাথে সম্পর্কিত হয় না কিংবা তাদের সাথে সংযুক্ত হতে পারে না উপন্যাসের ব্যপ্তিতে।
মূলত গত বছর অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে, প্রতিটা ঘটনাই কোনো না কোনো ভাবে অমানবিক, লেখক এই ঘটনাগুলোকে পূঁজি করে একতা মায়াময় আবহ তৈরি করতে চেষ্টা করেছেন, তবে যেহেতু ঘটনাগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন তাই জুড়ে দেওয়ার নিপূন সূচীশৈলীর অভাবটা প্রকট।
(আমার বক্তব্য, ফিকশনের জন্ম রিপোটিং-এর গর্ভে। একটু অন্য রকম বললে, পৃথিবীর সব কলাই প্রকৃতির নকল। একেকজন একেক রকম নকলবাজি করে এই যা! চোখে দেখা, পড়ে শোনা ঘটনা নিয়ে লিখতে বাধা কী!)

উপন্যাসের মূল ঘটনা ৩টি। বাংলাদেশ বিমানের কেবিন ক্রুদের জন্য অমানবিক একটা অলিখিত নিয়ম আছে, গর্ভবতী হলেই তাদের বরখাস্ত করা হবে, এই নিয়ে তারা একটা মামলা করেছিলেন, সেটায় রায় হয়েছে, সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়া এবং এর অমানবিকতা একটা প্রসঙ্গ, দ্বিতীয় প্রসঙ্গ হচ্ছে শিশু মাদকাসক্তি এবং মূলত যা এই উপন্যাস লিখবার তাড়না সেই খোদেজা উপাখ্যান।

লেখক নিজে তাদের সাথে কোনো সংযুক্ততা বোধ করেন না। তারা নেহায়েত খবরের কাগজের করুণ রিপোর্ট হয়ে থাকে, রক্তমাংসের শরীর নিয়ে সামনে উপস্থিত হতে পারে না। মূলত তারা নিজের চরিত্রের কয়েকটা আঁচর হিসেবে থেকে যায়। কয়েকটা রেখা দিয়ে একটা মানুষের মুখ চিহ্নিত করা যায়, তবে সে মুখে আদল আর অনুভূতি ফোটাতে অনেক রঙ খরচ করতে হয়। এখানে লেখক শুধুমাত্র কয়েকটা আঁচর দিয়ে নিজের দায়িত্ব সমাপ্ত করেছেন।
কেনো এমনটা হলো এটা লেখক ছাড়া অন্য কেউ বলতে পারবে না।
(আমার উত্তর: এই বিষয়ে অনেক কথা বলার ছিল। আমি ওই পথ ধরে হাঁটলাম না। কেবল পোস্টের সঙ্গে এই স্কেচটা দিলাম। এই স্কেচটা আমি দাঁড় করেছি কেবল ৩টা রেখা দিয়ে। এখানে একটা ফিগার দাঁড় করিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। এটা বলার আবশ্যকতা দেখি না: এটা একজন মার স্কেচ। মা-টার গর্ভ হয়েছে। তাঁর সন্তান ছেলে না মেয়ে এইসব নিয়ে বলারও আগ্রহ নাই! আমি পাঠককে অসম্ভব বুদ্ধিমান মনে করি- চলমান একেকটা ক্ষুরধার ব্রেন। সবই বলে দিলে পাঠককে নিবোর্ধ ভাবা হয়। পাঠককে এমনটার ভাবার সাহস আমার নাই।)

লেখার আরও একটা সীমাবদ্ধতা হলো লেখকের উপস্থিতি এবং ভাববিনিময়। এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই যে লেখক নিজে চরিত্র হয়ে তার লেখায় উপস্থিত থাকতে পারবে না, তবে এখানে লেখক প্রথম পুরুষে বর্ণনার ভার নেওয়া কোনো চরিত্র নয়।
ব্যক্তিগত পরিচয় এবং অনেক দিন ধরে তার লেখা পড়বার সুবাদে জানি এখানের অনেকগুলো লেখা এবং মন্তব্য সামহোয়্যারের অতীতের পাতা থেকে তুলে নেওয়া। হয়তো সাময়িক ভাবশূন্যতা কিংবা কিছু একটা দিয়ে পৃষ্টা ভরাতে হবে এমন কোনো ভাবনা থেকেই অসম্পাদিত অবস্থায় সেটা সরাসরি খোদেজা উপন্যাসের অংশভুক্ত হয়েছে।
(ভাল! যে দু-চারজন পাঠক বইটা পড়বেন তাঁদের ওয়েবে আমার সঙ্গে পরিচয় নাই এটা ভেবে খানিকটা আরামের শ্বাস ফেলি।)

চরিত্র বিশ্লেষনঃ নাগরিক চরিত্র নিশি, যে একজন এয়ারহোস্টেস এবং গর্ভবতী তার সাথে লেখকের পরিচয় হয় কোনো এক ব্লগ সাইটে। নিশি এখানে পাঠক, তার নিজের প্রবল আকাঙ্খা সে এই সন্তানের জননী হবে।
তার স্বামী জাবীর মূলত স্বপ্নভুক মানুষ, পরিবারবিচ্ছিন্ন এবং যথাযোগ্য রকমের ভাববিলাসী, পলায়নপ্রবন চরিত্র, তার কোনো আগ্রহ নেই এই সন্তান গ্রহনের। তার নিজস্ব অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার গল্প এখানে জড়িত।
(ওয়েবের লেখালেখির অংশবিশেষ বইয়ে দেয়া যাবে না এমন তো কোন কথা নাই। কেন, এ গ্রহের কোথাও বসে কোন চরিত্র, যে ওয়েবে তার কোন পছন্দের লেখকের লেখা পড়ছে? এমনটা কী হতে পারে না!)

সোহাগ, নিশি জাবীরের পরিবারের শ্রম সহায়ক শিশু, সে খোদেজার ভাই।
এইটুকু স্মৃতিময় যোগাযোগ ছাড়া আর কোথাও উপন্যাসে এই ৩ জনের সাথে খোদেজা কিংবা লেখকের যোগাযোগ নেই।
(ওই ৩ রেখার স্কেচটার কথাই আবার বলব।)

খোদেজা এবং তার বাবা, উপন্যাসের মূল চরিত্র না হয়েও পুলিশ অফিসার জুনাব আলী এবং ওবায়েদ যারা ঘটনার সমাপ্তি ঘটান মেলোড্রামাটিক উপায়ে, তারাই মূলত সবচেয়ে বেশী লেখকের অনুকম্পা পেয়েছেন।
(ওবায়েদ সাহেব, হুঁ। আসলে এটা চরিত্র না, একটা স্বপ্নের নাম।)

নিশি চরিত্রটির নিজস্ব দ্বিধা এবং যাতনা , জাবীরের পলায়নপ্রবনতা, সোহাগের ছিটকে পড়া এবং সাময়িক উদ্ধার অমীমাংসিত, খোদেজাও তেমনভাবে প্রাণ পায় না, যতটা ওবায়েদের প্রতিক্রিয়ায় পায়। এবং ওবায়েদ স্বর্গচ্যুত এক দেবতার মতো হঠাত এসে উদয় হয় খোদেজার গ্রামে, এক দিনে সে সামাজিক দায়বদ্ধতা চুকিয়ে বিদায় নেয়।
এই চরিত্র লেখকের ন্যায় দেওয়ার প্রবল আন্তরিকতায় সৃষ্ট। লেখকের এই প্রাণপন প্রচেষ্টার কারণে শেষ পর্যন্ত এই ওবায়েদের উপরেই একটা শ্রদ্ধাবোধ জন্মায়। তবে পাঠক ভীষণভাবে প্রতারিত হয়। অন্তত লেখক শিশু নির্যাতন এবং এই অমানবিকতার প্রতি যে সীমাহীন ঘৃণা নির্মাণের একটা পটভূমি পেয়েছিলেন, এই নির্যাতিতকে ন্যায় দিতে গিয়ে তিনি এই সুযোগটা হেলাফেলায় নষ্ট করলেন, এবং সম্ভবত তার নিজস্ব কষ্টবোধ লাঘব হলেও সামাজিক সচেতনতা এবং প্রতিবাদী মনন তৈরির পথ রুদ্ধ হয়ে গেলো।

উপন্যাসটির পরিশিষ্টে এই দায়মোচনের চেষ্টা ছিলো লেখকের তবে আমার মনে হয় লেখকের নির্মোহ অমানবিক রুঢ়তা থাকলে এটা চমৎকার একটা উপন্যাস হতে পারতো। মানবিকতার চিত্রায়ন যেভাবে এসেছিলো তাতে এটার গন্তব্য ছিলো অনেক দূর, তবে এই যাত্রা কেনো ব্যর্থ হলো, কেনো চমৎকার একটা হতে পারতো উপন্যাসের অপমৃত্যু ঘটলো, এটার উত্তর কার কাছে?
(আমার উত্তর নাই। এই ছড়িটা পাঠকের হাতে)। পাঠক দুয়েক ঘা মারলে সহ্য করা ব্যতীত উপায় কী!)

আমাদের ফর্মা ধরে উপন্যাস লিখবার প্রকাশকীয় চাপ কিংবা আমাদের লেখকের অতিরিক্ত করূণা এবং ন্যয় প্রত্যাশী মনন, কিংবা লেখার সাবলীলতা স্বত্ত্বেও যদি বলি লেখকের নিজস্ব ব্যর্থতা। লেখক নিজেও অলিখিত চাপে ভুগছেন তবে?
(এখানে আমি নিরুত্তর। এও সত্য বটে, অখ্যাত লেখকের কাছে প্রকাশক হচ্ছেন দ্বিতীয় ঈশ্বর!)

...............
পরিশেষে অন্য প্রসঙ্গ,
পৃথিবীর সেরা শেফ অসম্ভব যত্ন নিয়ে রান্না করলেন। সমালোচক খেয়ে, তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বললেন, লবন আরেকটু বেশি হলেই সর্বনাশ হয়ে যেত আর কী!


হা হা হা।


খোদেজা: ৩

Saturday, April 11, 2009

একটি ভাল ভুল- একটি খারাপ ভুল!

৭ই মে। বরাবর যা হয়, এবারও তাই হল! যথারীতি এবারও ৭ই মে। অন্যান্য দিনের মত করে সব কাজ সারছি, তারে-নারে ভাব। সকাল গড়িয়ে দুপুর। হোম মিনিস্ট্রি থেকে হোম মিনিস্টারের ফোন। ইস্তারি(!) সাহেবার ফোন। ফোনে উত্তাপ স্পষ্ট টের পাচ্ছি।
ইস্তারি(!) সাহেবা: আজ তারিখটা কত?
আমি অবাক: কেন, বাসায় কি তারিখের যন্ত্র, আ মীন, কেলেন্ডার-ফেলেন্ডার কিছু নাই!
ইস্তারি সাহেবা (হিম গলায়): থাকুক, তুমিই বল না, শুনি একটু?
আমি (গলায় আলগা কাঠিন্য এনে): এটা রসিকতা করার সময় না। কাজের সময়।
ইস্তারি সাহেবা: আমার সঙ্গে চালবাজী করবা না, তুমি কলম চালানো ছাড়া যে অন্য কোন কাজ পার না সে আমি বিলক্ষণ জানি। আমি তোমার ছাতাফাতা আবর্জনা লেখার পাঠক না। তোমার কলমবাজী ওদের জন্য তুলে রাখো। এ্যাহ, ভারী একজন কলমবাজ হয়েছেন তিনি, এক পাতা লেখতে ১০টা বানান ভুল!
আমি (চিঁ চিঁ করে): বিষয় কি, তারিখের সঙ্গে লেখালেখির সম্পর্ক কী! আজ ৭ই মে, তো?
ইস্তারি সাহেবা: তো! লজ্জা করে না তো বলতে, চশমখোর কোথাকার। বুড়া কুইচ্চা মাছ। তোমার সঙ্গে কথা বলতে এখন আর ভাল্লাগছে না।
আমি (হড়বড় করে): শোনে শোনো, ফোন...।

ফোন কেটে দিলে আমি আকুল পাথার ভাবছি। কাহিনী কী! ৭ই মে, এই দিনে কি প্রলয় হয়েছিল যে মনে না রাখলে মাথা কাটা যাওয়ার দশা। এই দিন কী আমেরিকা জাপানে আনবিক বোমা ফেলেছিল, কেন আমার মনে রাখা প্রয়োজন? ১৩১০ গ্রাম মস্তিষ্কের উপর চাপ পড়ছে। লাভ কী, এই দুর্বল মস্তিষ্কের সেই শক্তি কই! আচ্ছা, আজ সকালেই বাসায় ফোটা মে ফ্লাওয়ার দেখে কি যেন একটা ভাবনা এসেও তাল কেটে গিয়েছিল? ইয়া মাবুদ, আজ থেকে ১০ বছর আগে এই দিনই বিবাহ করেছিলাম। একটি ভাল ভুল!

পায়ে কুড়াল মারা হলো নাকি কুড়ালে পা মারা হলো এ নিয়ে গবেষণা করার আর কোন অবকাশ নাই। কিন্তু দেখো দেখি লোকজনের কান্ড, এরিমধ্যে আমার এক সুহৃদ ফোন করে ইস্তারি সাহেবাকে ১০ বছর আগের করা আমার এই ভুলটার জন্য শুভেচ্ছা জানালেন। কেন রে বাবা, এটা উনাকে না বলে আমাকে বললে কী আকাশ ভেঙ্গে পড়ত!
ইস্তারি সাহেবাকে কি ভাবে ম্যানেজ করলাম সে কাহিনী বলে অন্যদের বিরক্ত করার কোন মানে হয় না। সন্ধ্যায় শুধু একবার তিনি চিড়বিড় করে বলেছিলেন, ভাঁড় কোথাকার।
ভাঁড় বলার কারণটা অতি তুচ্ছ। সন্ধ্যায় আমি ১০ বছর আগের বিবাহের পোশাকটা শখ করে পরেছিলাম। এই বিবাহের পোশাকটা, বরাবর যা পরি তাই পরেই বিবাহ করেছিলাম। সেই জিনস, সুতি শার্ট।
বিবাহের সময় কিছু অনায্য শর্ত ছিল আমার। পোশাক থাকবে এই। কন্যা ব্যবহারের কিছু কাপড় ছাড়া অন্য কিছু আনতে পারবে না। বরযাত্রী থাকবে সর্বসাকুল্যে ৭/ ৮ জন।

বিবাহের সময় মজার অনেক ঘটনার একটা ছিল এই রকম। আমি বসে আছি। কাজী সাহেব অনেকটা সময় বসে থেকে উসখুস করে বললেন, জামাই এখনও আইলো না, আমার তো আরেকটা বিয়া পড়াইতে হইব। একজন যখন আমাকে দেখিয়ে বললেন, জামাই তো আপনার সামনেই বসা। কাজী সাহেব সময় নিয়ে চশমা ঠিক করে ভাল করে আমাকে দেখলেন। টুঁ শব্দও করলেন না। কিন্তু তাঁর মনের ভাব বুঝতে আমায় বেগ পেতে হয়নি। তিনি যা ভাবছিলেন, এই বান্দর কোত্থিকা আমদানী হইল! আমি তাঁর দোষ ধরি না। পালিয়ে বিয়ে করলে এক কথা কিন্তু সেটেল ম্যারেজে একজন কাজীর এমনটা ভাবা বিচিত্র কিছু না।

আমার এই পাগলামির অন্য কোন কারণ ছিল না। আমার প্রবল আশা ছিল, আমার এই পাগলামি অন্য কোন একজন যুবকের মধ্যে সংক্রামিত হয় যদি। একটা অন্য রকম লোভ! লাভের লাভ হল কচু। ফাঁকতালে পাগল হিসাবে কুখ্যাতির পাল্লা ভারী হল। জোর গুজব, কারা কারা নাকি আমাকে দেখেছে ছাদে নাংগুপাংগু হয়ে আকাশের সঙ্গে কথা বলতে। এতে আকাশের কি এসে গেল জানি না তবে আমার দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয় বাতাস!
যাই হোক, বিবাহের দিনটা ভুলে যাওয়া কাজের কোন কাজ না। একটা খারাপ ভুল!

Thursday, April 9, 2009

খোদেজা: ৩

খোদেজা: ২

খোদেজার বাপ ভয় চেপে আছেন। মাতব্বর তাকে কেন ডেকেছেন এটা বুঝতে তার বাকি নেই। এই মাতব্বর পারে না এমন কোন কাজ নেই। থানা নাকি এ পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়- দিনকে রাত, রাতকে দিন করতে এর জুড়ি নেই।
ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, ক্ষুধার্ত খোদেজার বাপ গামছা দিয়ে মুখ মুছলেন। তিনি আকুল হয়ে ভাবছেন, কী এমন অন্যায় করলেন যে খোদা তাকে এমন শাস্তি দিলেন। নাহয় নামাযটা সময় করে পড়তে পারেন না কিন্তু এই একটা অন্যায়ের জন্য খোদা তাকে শাস্তি না দিয়ে এইটুকুন দুধের বাচ্চাটাকে কেন দিলেন?

পা টেনে টেনে হাঁটছেন। সাঁকোটা পার হতে গিয়ে খরস্রোতা নদিটির দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। খুব ইচ্ছা করছিল লাফিয়ে পড়তে। এভাবে চলে গেলে যে খুব গোনাহ হয় এটা ওর জানা নেই এমন না। কিন্তু এই মুহূর্তে সোয়াব-গোনাহ নিয়ে ওর বিন্দুমাত্র ভাবনা নেই।
কেবল মাথায় যেটা ঘুরছে, আম্মাজানরে যারা এইভাবে কষ্ট দিয়েছে তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে, ভয়াবহ শাস্তি। আচ্ছা, দাঁ দিয়ে এদের দুইজনকে দুইটা কোপ দিলে কেমন হয়? নাহ, আমি এটা করব না। আইন এদের শাস্তি দিবে, দুনিয়ার অন্য বাপ-মাদের এটা জানা দরকার। আইন শাস্তি না দিলে জমিতে দেয়া বিষ খেতে তার হাত একটুও কাঁপবে না।

মাতব্বর দবির মিয়াকে বাড়িতেই পেলেন। মাতব্বর দবির মিয়া খুব খাতির করার ভান করল। এই গ্রামে চেয়ার আছে কেবল অল্প কটা বাড়িতে। জোর করে চেয়ারের আয়োজন করল। কড়িকাঠে বাঁধা চেয়ার, দড়ির গিট ছেড়ে বেশ কায়দা-কানুন করে নামানো হল। খোদেজার বাপ যতই না না করেন কিন্তু কে শোনে কার কথা!
'আরে মিয়া, তুমি হইলা গিয়া মেহুমান-কুটুম্ব। তুমার একটা ইজ্জত আছে না, এইটা তুমি কি কইলা মিয়া।'

খোদেজার বাপ ভাল করেই জানেন, এইসব কথার আসলে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নাই। অন্য কোন সময় তিনি মাতব্বরের বাসায় চেয়ারে বসতে গেলে মাতব্বর লাথি মেরে চেয়ার ফেলে দিত।
খোদেজার বাপ জড়োসড়ো হয়ে চেয়ারে বসলেন। অভ্যাস নেই বলে বসে ঠিক জুত করতে পারছেন না।
'মিয়া তামুক খাইবানি একটু?'
'জ্বে না-জ্বে না।'
'না খাইলেই ভালা, তামুক-টামুক শাইস্তের লিগ্যা ভালা না, বুঝলা।'
'জ্বে। খোদেজার বাপ ভাল করেই জানেন, এর সামনে এখন নারকেলের হুক্কা খেলে পরে এটা নিয়ে চরম অপমান করবে।'
'তো মিয়া, দারগারে কয়া দেই তুমার মত আছে।'
খোদেজার বাপের বিভ্রান্ত চোখ, 'কুন বিষয়ে?'
'আরে, তুমি দেখি আজব মানু- আমি কই কি আর দারগা লেহে কি! কইলাম তুমার মাইয়ার বেপারে মিটমাট হয়া গেছে এইডা দারগারে কয়া দি।'
'মাতব্বর সাব, এটাডা আফনে কি কন। এমুন অন্নাই-অনাছার আল্লাও সইব না।'
'হারে, মসিবত হইল। আল্লারে আবার টানাটানি কর ক্যা! গাংয়ের মড়া কুডা দিয়া টাইন্যা লাভ আছে, কও?'
'আমার মাইয়াডা-।'
'দেহো মিয়া, আগুন খাইলে আংড়াই তো লেদাইবা- মাইয়া জন্ম দিছ, ভেজাল হইব এইটা তো নতুন কিছু না। পুলাপাইন মানু, হেগো মাথা গরম হয়া গেছিল, একটা ভুল কইরা ফালাইছে, কি করবা কও। তুমার পুলা হইলে কি করতা, ফালায়া দিতা?'
'মাতবর সাব-!'
'হুনো মিয়া, হেরা ভুল স্বীকার করছে। দরকার হইলে গামছা গলায় দিয়া মাপ চাইব। হেরা টাউনের পুলাপাইন না যে এইটা কইলে কইব, মাতবর সাব, গামছাডা নতুন দেইখ্যা দিয়েন। তুমার মনে আছে নি, হেই বিচারটার কতাডা? গামছা গলাত দিয়া মাপ চাইব এই রায় দিয়া শেষও করতাম পারি নাই, বাড়ির পিছে কুয়াটায় ডুপ্পুস কইরা আওয়াজ হইল। আমরা গিয়া দেখলাম, সব শ্যাষ, মানুডা অফমানে কুয়াতে ঝাপ দিছে। আমি কই কি সোহাগের বাপ, তুমি এইসব ঝামেলাতে যাইও না, হেষে মার্ডার কেইসে পরবা। আল্লার কিরা, যতখন তুমি মাফ না দিবা, হেরা ততখন তুমার ঠ্যাং ধইরা বয়া থাকব, তুমারে কতা দিলাম। লড়ছড় হইলে জুতাত কামুড় দিমু।'
'এইডা আমি পারুম না, মাতবর সাব।'
'দেহো, আমি সুজা-সরল মানু, ছ্যাপ লেপ দিয়া কুনু বিছার করি না। আমি হেরারে কয়া দিমু নে, তুমারে দুই পুলার বাপ দুইডা হালের গরু দিব। না দিলে পুংগির পুতরারে কি করি তুমি দেইখো। এমুন বেদা দিমু, হাগা বাইর হয়া যাইব। আমি এমুন মাতবর না যে, মুইত্যা চিড়া ভিজত না।'

খোদেজার বাপ চুপ করে বসে রইলেন। তিনি পায়ের কাঁপুনি থামাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।
'হুনো, দাদার বিয়ার পর তো আর ঢোলের বাড়ি পড়ে নাই। তুমার হালের গরুগুলা দেখছ, ঠ্যাং-এ ঠ্যাং বাড়ি খায়।'
'মাতবর সাব, আমারে মাফ কইরা দেন, আমি পারুম না।'
'দেখ মিয়া, আমার লগে হিলিঝিলি-বদরসদর কথা কইবা না। যা কইবা সাফ সাফ হও। টেটনামি কইরো না।'
'মাতবর সাব, আমি আইনের কাছে বিচার চাই।'
'মিয়ার বেটা হুমন্ধির পুত, বেশি বেলাইনে যাইও না কইলাম। মিজাজ বিলা কইরো না কইলাম। কামডা বালা করতাছ না কইলাম।'
'আমারে মাফ করেন, মাতবর সাব।'
'মিয়া, তুমার কতা হুইনা মনে পড়তাছে, ছাল উডা কুত্তা বাঘা তার নাম। বাপজাইট্যা কোনখানকার! হালা তোরে আমি বেদাও মারি না।'
'মাতবর সাব, আল্লার দুহাই আমারে-।'

মাতবর নামের মানুষটা অপলক তাকিয়ে রইল। এই মুহূর্তে মানুষটার স্বরূপ বেরিয়ে এসেছে। এখন যে কেউ অনায়াসে বলে দিতে পারবে এই মানুষটা মধ্যে কেমন একটা অশুভ লুকিয়ে আছে। এর দৃষ্টিতে বিষ, নিঃশ্বাসে বিষ। মানুষটা গলায় বিষ ছড়িয়ে বলল, 'তোর মাইয়্যা হইল পেটলাগানি- পেটলাগানি গো যা হয় তোর মাইয়ার তাই হইছে, আফসোস তোর মাইয়ার লগে আমি করতে পারলাম না।'

খোদেজার বাপ এখান থেকে বেরিয়ে নদির কিনারে উবু হয়ে বসে হাউমাউ করে কাঁদলেন। দূর থেকে কেউ দেখলে ভাববে মানুষটা প্রাত্যহিক জরুরি কোন কাজ সারছে। তাঁর চোখের জল মিশে যাচ্ছে নদির জলে। ক্ষণে ক্ষণে তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলছেন।

মানুষটা সেলিব্রেটি হলে কোন একটা উচুমার্গের কথা চলে আসত নিশ্চয়ই। নদির জলের সঙ্গে, আকাশ-বাতাস টেনে এনে কাব্যিক কোন একটা বাক্য চলে আসত অনায়াসে। কিন্তু খোদেজার মতো সামান্য একটা মেয়ের হতদরিদ্র বাবার এই কষ্টের কথা জানার খুব একটা প্রয়োজন নাই এই ব্যস্ত পৃথিবীর। তাঁর চোখের পানি যেমন অনাদরে মিশে যায় নদির পানিতে, তেমনি তার চাপা আর্তনাদও মিশে যায় বাতাসে।...

Wednesday, February 4, 2009

খোদেজা : ২

খোদেজার মা খোদেজাকে ডেকে ডেকে হয়রান, কই ল মুখপুড়ি, উত্তর দ্যাস না ক্যা!
খোদেজা ইচ্ছা করেই উত্তর দিচ্ছে না। মা-র উপরও ওর রাগ, কঠিন রাগ। মা কেন বাজানকে বুঝিয়ে বলেন না। মা বললে বাজান গুরুত্ব না দিয়ে পারবেন না।
ও বুঝতে পারছে মা খুব রেগে আছেন। এমনিতে মা ওকে ডাকলে সুর করে বলেন: কই রে আমার লেংটি বেডি, কই রে আমার ছেংটি বেডি। মা এটা অনেক আগে থেকেই বলে আসেন। খোদেজার সমস্যা হল, ও এখনও বিছানা ভাসিয়ে ফেলে। মা গুমগুম করে পিঠে কিল দিতেন আর বলতেন: থুয়া-থুয়া-থুয়া, এত্তো বড় মাইয়া বিছনায় মুতে! সকালে উঠে নিয়ম করে বলতেনই বলতেন: লেংটি বেডি-ছেংটি বেডি, লেংটা ভুতুনি খেতায় মুতুনি।


খোদেজা তীক্ষ গলায় চেঁচিয়ে উত্তর দিল, পদাপদি করবা না, ভালা লাগে না।
ইশ, আমার হড়ি-আম্মা, আমার সুয়ামির আম্মা গো, ডরাইছি।
মা, কতা কইবা না আমার লগে।
কি হইছে আপনের, এত চেত ক্যা? আপনে কি ধাইন্না মরিছ?
মা, আমার লগে কতা কইয়ো না কইলাম।
খোদেজার মা হাসি লুকিয়ে নরম গলায় বললেন, লবন দিয়া কানে ডলা দিলে বুঝবি। কি হইছে ক।
তুমার চোউক নাই?
আছে দুইডা, হইছে কী?
তুমি দেখো না, আমার হাসগুলা মইরা যাইতাছে।
তোর হাস কি আমি গলা টিইপ্যা মাইরা ফালাইতাছি?
খোদেজার এবার ধৈর্যচ্যুতি হল, তুমি বাজানরে কইতে পার না হাসগুলারে পশু হাসপাতালে লয়া যাইতে।
হুনো মাইয়ার কথা! এই ছেমরি, তুই হাগল নি কুনু, ডাক্তার তোর হাসের চিকিত্সা করার লাইগ্যা আক-কইরা বয়া রইছে, না?
হ। বয়া রইছে।
ইশশ, বয়া রইছে পিঁড়ি বিছায়া।
মা, রস করবা না।
হুনো মাইয়ার কতা। অই, তোর লগে রস করুম কা। ইস, আইছে আমার রসের নাগর।
বেডির ঘরে বেডি, তুমার লগে আমি মাতি না।
না মাতলে নাই, বুড়া তোর হাই।
মা, ভালা হইব না কইলাম।
যা-যা, তোর কপালে পিছার বাড়ি।

খোদেজা উত্তর দিল না। চোখের দৃষ্টিতে কেমন একটা ত্রাস! কি এক ভাবনায় তলিয়ে গেছে। খোদেজার মা তার সন্তানের ভাবান্তর লক্ষ করেন। মেয়েটার কি যেন হয়েছে ক-দিন ধরে কিছু বললে কেমন চমকে উঠে। কেমন সন্ত্রস্ত একটা ভাব।
কি হইছে আমার ফাগলি বেডির!
কিসসু না।
কিছু কইলে চমকায়া উঠস ক্যা? তোরে খন্‌কারের কাছ থিক্যা তাবিজ আইনা দিমু নে। আলগা দুষ থাকলে যাইব গা।
তাবিজ লাগব না।
এবার খোদেজার মা খোদেজার জট বাধা চুল মুঠ করে ধরলেন। জট ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন, থুয়া, কেমুন হুডা হইয়া রইছে। তুই আউলা চুলে থাকস দেইখ্যাই আলগা দুষের লিগ্যা তাবিজ লাগব। সারাদিন খালি হাস হাস করলেই হইব, চুল বাংলা সাবান দিয়া ঘসাইলে কি হয়? আবার গোসল করলে কইস তোর মাথাডা ভালা কইরা ধুইয়া দিমু নে।
গোসলের কথা শুনে খোদেজা কুঁকড়ে যায়, অজান্তেই ওর শরীর কেঁপে কেঁপে উঠে। খোদেজার মা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন, কিরে, তোর কি হইছে? এমুন করতাছস ক্যা?
কিসসু হয় নাই।
হারামজাদি, থাপড়াইয়া কানপট্টি ফাটায়া ফেলাম। ক, কি হইছে?


খোদেজা চোখের নিমিষে মাকে জড়িয়ে ধরল। কান্নার দমকে হেঁচকি উঠে গেছে। মা একে শান্ত হওয়ার জন্য খানিকটা সময় দিলেন। গায়ে-পিঠে হাত বুলিয়ে ভাঙ্গা গলায় বলে যাচ্ছেন, কান্দে না, আমার মা কান্দে না। খোদেজা, আম্মা কন কি হইছে? মার কাছে কুনু ডর নাই। মার লগে হগ্গল কতা কওন যায়।
অনেকক্ষণ পর খোদেজা খানিকটা সুস্থির হয়। নিচু গলায় থেমে থেমে বলল, মা, কাইল না আমি হাসের শামুকের লিগ্যা বিলে গেছিলাম। গরম লাগতাছিল, ফানিতে ডুব দিলাম। শফিক ভাই-।
কোন শফিক, মাইঝ পাড়ার শফিক?
হ, মা।
হেষে?
শফিক ভাই আমারে দেইখা কেমুন কেমুন করতাছিল।
খোদেজার মা চেঁচিয়ে বললেন, হেষে কি হইল, হেইডা ক।
আমার শইল ধরতে চাইছিল।
হেষে?
টেরেনটা আয়া খাড়াইছে দেইখ্যা ছাইড়া দিল। আমি এক দৌড়ে বাড়িত আইলাম।


খোদেজার মার গা কাঁপছে। তিনি তার মেয়েকে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। যার অনেকগুলোর অর্থ খোদেজার জানা নাই। খোদেজার এটাও বোধগম্য হচ্ছে না, মা তার শরীর হাতড়ে কি খোঁজার চেষ্টা করছেন!
খোদেজার মার গায়ের কাঁপুনি খানিকটা কমল। তিনি বিড়বিড় করলেন, আল্লা, আমার মাইয়ার ইজ্জত বাঁচাইছ, না খায়া হইলেও মসজিদে মোমবাতি দিমু।
মা, শফিক বাই এমুন করতাছিল ক্যান?
এইগুলা বদ কতা, আল্লাজী গুনা দেয়। হুন খোদেজা, আর কুনু সময় না কয়া বাইত থন দূরে যাইবি না আর শফিকের লগে ভুলেও কথা কইবি না।
কিন্তক মা, শফিক বাই এমুন করল ক্যান?
কইলাম না এইসব বদ কতা। আবার জিগাস।
মা, আমি কিছুই বুঝতাসি না।
এত বুঝার কাম নাই। তুই না কয়া কুনহানেও যাইবি না।
আমার হাসরে হামুক আইন্যা দিব কেডায়?
পিছা মারি তোর হাসের কপালে। হাস হাস হাস, হাস ছাড়া আর কতা নাই।
হাস তুমার কি অনিষ্ট করছে!
অই ছেমরি, অত কতার কাম নাই। তুই আমারে না কয়া কুনহানে যাইবি না। কতা শ্যাষ।
বাজানের খাওন লয়া যাইব কেডায়?
খোদেজার মা চিন্তায় পড়ে গেলেন, তাই তো? খোদেজা ছাড়া তো খাবার নিয়ে যাওয়ার মানুষ নাই। খোদেজার মা নিয়ে যেতে পারবেন না, নিয়ম নাই। গ্রামের নিয়ম কোন মহিলা ফসলের জমিতে পা রাখতে পারে না।


খোদেজা মাথা ঘামাচ্ছে অন্য বিষয় নিয়ে। খোদেজা বুঝে উঠতে পারছে না এইসব রহস্যময় আচরণ। মা কেন এমন করলেন! তার ভাবনার জগৎ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

সহায়ক সূত্র:
১. খোদেজা: ১

Tuesday, January 6, 2009

অন-লাইনে লেখালেখি হচ্ছে গণিমতের মাল!

'খোদেজা' নামের একটা উপন্যাস আছে আমার।
এই উপন্যাসের খানিকটা-অংশবিশেষ, একজনের অনুরোধে আমার সাইটে পোস্ট করেছিলাম। খোদোজার অংশবিশেষ

হুবহু এই লেখাটি, দাঁড়ি-কমাসহ 'যৌবনযাত্রা' নামের সাইটে পোস্ট করা হয়েছে- অহেতুক, কোন কারণ ছাড়াই। মূল আবেদনটাই অন্য রকম হয়ে গেছে- খোদেজা উপন্যাসটা হচ্ছে ১টা শিশুর উপর চরম নির্যাতন নিয়ে

লিখিত দূরের কথা নিদেনপক্ষে মৌখিক অনুমতি নেয়ারও প্রয়োজন বোধ হয়নি। (অথচ আমার সাইটে আমি স্পষ্ট সতর্কবাণী দিয়ে রেখেছি, আমার লিখিত অনুমতি ব্যতীত কোন লেখা বা এর অংশবিশেষও কোথাও প্রকাশ করা যাবে না।)
গুগলে আমার নাম দিয়ে সার্চ দেয়ায় বিষয়টা চোখে পড়ল নইলে জানতেই পারতাম না এমন হার্মাদের (ছিনতাইকারীর সফট ভার্সন)
'হার্মাদী'!

এমন অর্বাচীন আচরণের জন্য তীব্র নিন্দা।

Thursday, June 5, 2008

খোদেজার অংশবিশেষ

খোদেজার সকাল থেকেই মন ভাল নেই। কারণ তুচ্ছ। ওর পোষা হাসগুলো কেবল ঝিম মেরে থাকে, কাল তো একটা মরেই গেল। কি যে কষ্ট হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল বুকটা কেমন যেন হালকা। কাল খোদেজা রাগে দুপুরে ভাতও খায়নি।
কষ্টের চেয়ে বেশি রাগ হচ্ছিল বাজানের উপর। বাজানটা এমন কেন, খোদেজা ক-দিন ধরে ঝুলাঝুলি করছে হাসগুলো সদরের পশু হাসপাতালে নিয়ে যেতে। বাজান হেসেই উড়িয়ে দেয়: বেটিরে, তুই ফাগলি, ভাত খাইবার ভাত পাই না, সাইকেল লইয়া হাগবার যাই। তিন টেকার হাস, নয় টেকার ভ্যাজাল।
খোদেজার মোটেও ভাল লাগেনি বাজানের কথা। বাজানটা এমন নিষ্ঠুর কেন? ওর হাসগুলোর বুঝি বাজানের কাছে কোন দাম নাই! বাজান কি বুঝবে, এরা তো বাজানকে প্যাঁক প্যাঁক করে ঘিরে ধরে না। হাসের বাচ্ছাগুলো আগের মতো আর নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে না। ঘোলাটে চোখ নিয়ে কেবল ঝিমায় আর ঝিমায়।

বাইরে সূর্যটার কী তেজ! মনে হয় সব পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। বাজান বলছিল এইবার ফসল ভাল হবে না। না হলেই কী, ওদের তো আর নিজস্ব জমি নাই। অন্যের জমিতে বর্গাচাষ করে যে ধান পাওয়া যায় তিন মাসের মাথায় শ্যাষ। এটা বাজান শুনলে খুব করে বকা দেবেন: কি কস মাইয়্যা, আমাগো কয়ডা ধানই দেখলি; মাইনষের যে এক কুড়ি, দুই কুড়ি গোলা ধান, হের কি হইব চিন্তা কর।
যদি খোদেজা বলে বসত: মাইনষের ধান দিয়া আমাগো কাম কি, মাইনষে কি আমাগো একবেলা খাওয়াইব?
যখন বাজান খুব রেগে যান তখন খোদেজাকে নাম ধরে বলেন। তখন নিশ্চিত বলতেন: খোদেজা, একটা চড় দিয়া তোর সব দাঁত ফালাইয়া দিমু, ফাজিল কুনহানকার, তোর খাওয়াখাওয়ি বাইর কইরা দিমু। তুবা কর, আল্লার কাছে মাপ চা। অণ তুবা করবি, আমার সামনে।
তখন খোদেজা বাজানের এই চন্ডাল রাগ দেখে কাঠ হয়ে থাকত। এমনিতে বড় ঠান্ডা মানুষ, সাত চড়ে রা নাই। কিন্তু বাজান এইসব একদম সহ্য করতে পারেন না।
এমনিতে মন ভাল থাকলে খোদেজার চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আমুদে গলায় বলবেন: বেটিরে, সব সুময় মনে রাখবি, আমাগো ভংশের কথা মনে রাখবি। দুনিয়াত দুই ধরনের মানু, চুর-বাটপার আর ভালা মানু। ভালা মানুর চরিত্র শ্যাষ হইলে আর হের দাম নাই। খুদাও হেরে ভালা পায় না। কব্বরের আজাব হেরে ছারখার কইরা দিব।
খোদেজা বাপের এইসব কথা সবটা মনোযোগ দিয়ে শোনে না। বুঝেই না সবটা। কতই বা বয়স ওর,ভাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেয়?
ওর জন্মের সময় নিয়ে বাজান বলেন: বড় ঢলডার সময় হইছিলি। চাইরদিকে আকাশ-পাতাল ঢলের পানি। তর মার গর্ভযন্ত্রণা শুরু হইল। হেরে লইয়া কই আর যামু? আমি কইলাম, সোহাগের মা, মনডারে শক্ত করো, যাগো কেউ নাই হেগো আল্লা আছে। দেখবা সব ঠিক হয়া যাইব। তুই যখন চিক্কুর দিলি বাইরে ঘুটঘুইট্যা আন্ধার, ঘরে আন্ধার। তোর মা সুমানে চিল্লাইতাছে: সোহাগের বাপ, ঘর আন্ধার থাউন ভালা না। বাচ্চাটার অমঙ্গল হইব। বাত্যি দেও। হুন দেহি তোর মার কতা, বাইত নাই এককিনি কেরাসিন, বাত্যি জালামু কইত্থন?

আহা, বাজানের আদরের সোহাগ। খোদেজা মন খারাপ করা শ্বাস ফেলে। ওর ভাইটাকে দেখেছে কবে মনেও করতে পারছে না। কেবল মনে আছে যেইবার খুব শিলাবৃষ্টি হল, আকাশ থেকে হুড়মুড় করে পড়া শিলা দু-জন মিলে জমাল, তার পরই সোহাগ ভাইজান চলে গেল।
খোদেজা, বাড়ির সবার কী কান্না। বাজান গামছা দিয়ে চোখ ডলছিলেন আর ভাঙ্গা গলায় একটু পরপর ধমক দিচ্ছিলেন: সবাই আল্লারে ডাকো, মন শান্ত হইব। আমার বেটা শহরে ভালা থাকব, ভালা খাইব, ডাঙ্গর হইব। আমরা ঘুরতাম যামু। আমার বেটা ঢাহা শহর ঘুরাইয়া দেহাইব।
ইশ, খোদেজা বুঝি মাকে বলা কথাগুলো শোনেনি! বাজান নিচুস্বরে যে বলছিলেন: সোহাগের মা, খিদার কষ্ট বড় কষ্ট। আমার পুলাটারে ঠিকমতন খাওন দিতাম ফারি না। আল্লা ভরসা, দেখবা সংসারের অভাব আর থাকব না। তুমি রাজরানি হয়া সুখ করবা।
মা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিলেন: পিছা মারি এমুন রাজরানির মুখে। আমার তেনাই ভালা, পুলার টেকায় আমার ভালা কাপড় পিন্দনের কাম নাই। অ সোহাগের বাপ, তুমি আমার বুক খালি কইরা দিয়ো না, তুমার দুইটা পায়ে পড়ি। আমার এমন অনিষ্ট কইরো না, তুমার আল্লার দুহাই লাগে।

খোদেজা ভাল লাগছে না, কিচ্ছু ভাল্লাগছে না। ইচ্ছা করছে ছনের ঘরটায় আগুন ধরিয়ে দিতে। পায়ে কিসে যেন ঠোকর দিতে ও লাফিয়ে উঠে খিলখিল করে হেসে ফেলল। অমা, এইটা দেখি চিনি। খোদাজার হাসের বাচ্চাগুলোর আলাদা আলাদা নাম আছে। নামগুলোও অদ্ভুত। কোনটার নাম চিনি কোনটার লবন। এ নিয়ে সবার কী হাসাহাসি! আসলে নাকি এদের নামের কোন গুরুত্ব নাই, সব হাসের বাচ্চাই নাকি একরকম। ইশ, রঙ্গ করলেই হল, বললেই হল! এরা দাগ দিয়া রাখুক না। চিনিকে ডাকলে চিনিই আসবে। ঠিক না হলে পিঠে দুমাদ্দুম করে দুই কুড়ি কিল বাজি।
খোদেজা গলা দিয়ে বিচিত্র শব্দ বের করছে তই তইই তইইই। জট পাকানো চুলগুলো ঝাঁকিয়ে বলল, কিরে চিনি, ঠুক্কুর দিলি ক্যা, আমি বুঝি দুক্কু পাই না।
সরলদৃষ্টিতে চিনি নামের হাসের বাচ্চাটিকে কেউ কিছু বলতে শোনেনি কিন্তু খোদেজার নাকি বুঝতে কখনই সমস্যা হয় না। খোদেজা নিচুস্বরে বলল, কি কইলি খেলা করস, একটা আছাড় দিয়া পেডা গাইল্যা ফালামু। তহন বুঝবি নে মজা। অমা, আমাগো লবন বিবির কি হইছে, রাগ হইছে, চিনির লগে কতা কইছি দেইখ্যা। তোর পেটটা ভরা হিংসা। আয় কাছে আয়, অই-অইত, বেশি ভংচং করিস না তাইলে কিন্তু তোর লগে কথা কমু না। তোরে কাউয়া ঠুকুর দিলেও ফিরা চামু না।
খোদেজা একমনে এদের সঙ্গে কথা চালিয়ে যায় আবার এটাও লক্ষ রাখে কেউ দেখে না ফেলে, তাইলে লজ্জার একশেষ! এমনিতেই হাসদের সঙ্গে এইসব কথা চালাচালি নিয়ে ওকে সবাই খেপায়। আর হাসগুলোও বজ্জাত কম না, এমনিতে কী ফড়ফড় করে কথা বলে, অন্য কাউকে দেখলেই চুপ। এই বজ্জাতগুলো ইচ্ছা করে ওকে অপদস্ত করে। একদিন তো খোদেজা রাগ করে এদেরকে খাবার পর্যন্ত দেয়নি। পায়ের কাছে কেমন ঘুরঘুর করে, রাগ করে থাকা যায় বুঝি!
রাগ ভুলে খোদেজা চোখ পাকিয়ে বলে, আর যুদি একটারেও মরতে দেহি এমুন মাইর দিমু। আইচ্ছা আয়, কয়ডা শামুক খুঁইজা দেই।

শামুক খুঁজতে গিয়ে রাস্তায় বড়ই গাছের টসটসে বড়ই ঝুলতে দেখে খোদাজের জিভে পানি চলে এল। হাতটা কেমন নিশপিশ করছে, কখন ঢিল ছুঁড়েছে বলতেও পারবে না। দূর থেকে কে যেন তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, আইল্যা বাড়ি জাইল্যা বাড়ি, বড়ি পাইরা লাইল্য, লাইল্য। খোদাজা ঝেড়ে দৌড় দিল, থামল গিয়ে বিলের পারে। খোদেজা রেল লাইনের বিলটায় সাবধানে নামে। আনন্দে বিড়বিড় করে, আল্লাগো পানি কী ঠান্ডা! শামুক খোঁজার কথা ভুলে যায়। আচ্ছা করে দাপাতে থাকে।
ওই মায়া, দিলি তো ভিজায়া।
নিমিষেই খোদেজার দাপাদাপিতে ভাটা পড়ে। হায়-হায়, এ দেখি ওদের গ্রামের শফিক ভাই। কী শরমের কথা, ওর কারণে শফিক ভাইয়ের উপর পানির ছিটা পড়েছে। কিন্তু ও যখন পানিতে নামল তখন কি শফিক ভাই এখানে ছিল? থাকলে তো দেখার কথা।
খোদেজা জিভে কামড় দিয়ে বলল, মাফ কইরা দেও শফিক ভাই, আমি দেহি নাই।
শফিক মুখে বলল, চোউককানি, যাঃ তোরে মাফ কইরা দিলাম।
মুখে কথাগুলো বলছে ঠিকই কিন্তু মানুষটার ভঙ্গিতে কি যেন একটা অসঙ্গতি আছে। স্থির চোখে তাকিয়ে আছে খোদেজার ভেজা কাপড়, ভেজা অপুষ্ট শরীরে। এই দৃষ্টি খোদেজার কাছে দুর্বোধ্য কিন্তু কেন জানি শফিক নামের মানুষটাকে ওর ভয় করছে। মানুষটা কেমন বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। নাক দিয়ে কিছু একটা শোঁকার চেষ্টা করছে।
শফিক ভাই, এমন করতাছেন ক্যান? হুংগেন কিতা, মনে হইতাছে গুয়ের গন্ধ পাইতাছেন?
শফিকের আরও এগিয়ে এসে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে জড়ানো গলায় বলল, হ, গুয়ের গন্ধই। এই গন্ধেই আমার মাথা খারাপ হয়া যাইতাছে।
খোদেজার কিছুই মাথায় আসছে না। এই লোকটা এখন একেবারে গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়েছে। এর শরীর থেকে তামুকের বোটকা গন্ধ ছাড়াও কেমন একটা অজানা গন্ধ মিশেছে। গন্ধটা খোদেজার সহ্য হচ্ছে না।
শফিকের কোমল গলা, লক্ষী মাইয়া, কিতা করতাছ এইখানে। ডুবাইতে আইছ? একলা একলা ডুইবা যাইবা তো। আইও, একলগে ডুবাই। দেইখো, খুব মজা হইব।
খোদেজার মুখের কথা মুখেই থেকে যায়। লোকটা ওকে সমস্ত শরীর দিয়ে আটকে ফেলেছে। মুখ দিয়ে কেমন বিচিত্র শব্দ বের হচ্ছে।
খোদেজা বিস্মিত হতেও ভুলে গেছে। লোকটার আচরণ ওর কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। সম্বিত ফিরল ট্রেনের হুইসেলের শব্দে। ট্রেনটা কাছের ব্রীজটায় কোন কারণে গতি কমিয়ে দিয়েছে।
শফিক নিমিষেই খোদেজাকে ছেড়ে নিরাপদ দূরুত্বে সরে এসে পশুর আক্রোশে ড্রাইভারকে গাল দিচ্ছে, চুতমারানির পোলা, খানকি বেডির পোলা...।
খোদেজার মাথায় ঢুকছে না। ট্রেনের ড্রাইভার এর কী ক্ষতি করল! এত ভাবাভাবি না করে খোদেজা রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে।