Search

Showing posts with label কনক পুরুষ. Show all posts
Showing posts with label কনক পুরুষ. Show all posts

Monday, August 23, 2010

কনক পুরুষ: ৯

জয় ভাসা-ভাসা জানত তন্ময়ের বাবার অফিস সেনাকল্যাণ ভবনে। ঠিক কোথায় এটা জানা ছিল নেই। কেয়ারটেকার গোছের একজনকে জিজ্ঞেস করতেই সমীহের একটা ভাব ফুটিয়ে তুলল আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘ষোলো তলায় চলে যান।’
‘ষোলো তলা মানে, ঠিক কোন পাশে?’
‘অ, জানেন না বুঝি, পুরোটাই তো।’

লিফট থেকে নেমে ওর চোখ ধাঁধিয়ে গেল। তন্ময়ের বাবা সাজসজ্জার পেছনে কী বিপুল অর্থই না ব্যয় করেছেন!
রিসেপশনিস্ট মেয়েটার মুখে মহিলা-ড্রাকুলার হাসি, ‘বলুন, আপনার জন্যে কি করতে পারি?’
‘আমি ফারুকী সাহেবের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাচ্ছিলাম।’
‘স্যার, কি আসার জন্য বলেছেন?

জ্বী না।
তাহলে দেখা হবে না।’
‘ব্যাপারটা খুব জরুরী।’
‘সরি, সম্ভব হচ্ছে না।’
‘প্লীজ, অন্তত ওনাকে বলে দেখুন।’
‘আচ্ছা, দেখি ওনার পি.এ-র সঙ্গে কথা বলে। মনে হয় না কিছু হবে। আপনার বিজনেস কার্ডটা দিন।’
‘আমার কার্ড নেই। আপনি বলুন, তন্ময়ের একজন বন্ধু দেখা করবে।’
মেয়েটি এবার টকটকে লাল ঠোঁট লম্বা করে চোখ অসম্ভব ছোট করে বলল, ‘চাকরির ব্যাপার নাকি?’
জয় সাপের দৃষ্টি নিয়ে বলল, ‘বলেছি আপনাকে চাকরির ব্যাপার?’
‘না, মানে।’
‘দয়া করে আজেবাজে কথা বলবেন না।’
মেয়েটির অপমানিত গলা,
ওখানে অপেক্ষা করুন।’

এসব কথা হচ্ছিল বারোটায়। এখন বাজে দুইটা। এই দুই ঘন্টায় কেউ কিছু জিজ্ঞেস করা দূরে থাক, তাকাল না পর্যন্ত। যেন ও একটা ফার্নিচার। এরা সবাই প্রচুর সময় নিয়ে চা খাচ্ছে, হেসে একজন অন্যজনের গায়ে ঢলে পড়ছে। ওকে চা অফার করার মত অভদ্রতা এখন পর্যন্ত কেউ দেখায়নি। চরম অপমানিত হবার মত ব্যাপার, গায়ে না মেখে উপায় নেই তবুও জয় তন্ময়ের কথা ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল। মানুষকে হেয় করে এরা কি মজা পায় কে জানে!
জয় আকাশ পাতাল রাগ নিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘কথা বলে দেখলেন?’
‘মানে!’
‘দুই ঘন্টা আগে বললেন না কথা বলে দেখবেন। আমি জানতে চাচ্ছিলাম, এই জটিল কাজটায় আপনার কি পরিমাণ সময় লাগবে?’
‘এমন করে কথা বলছেন কেন? স্যারকে আপনার কথা বলা হয়েছে, অপেক্ষা করতে বলেছেন।’
‘তন্ময়ের বন্ধু দেখা করবে এটা বলেননি?’

মেয়েটি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ‘জ্বী-ই-ই।’
জয় ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল। সোফায় মূর্তির মতো বসে রইল। বিশ মিনিট পর একজন এসে বলল,
ভেতরে যান, স্যার আপনাকে পাঁচ মিনিট সময় দিয়েছেন। মনে রাখবেন, জাস্ট পাঁচ মিনিট।’

বার্মা টিকের ভারী দরজা ঠেলে জয় ভেতরে ঢুকল । ঘর অন্ধকার, কোথাও আলো নেই। শুধুমাত্র নিচু একটা টেবিল ল্যাম্প উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। রিভলভিং চেয়ারে বসা ছায়া ছায়া মানুষটাকে ঠিক চিনতে পারছে না। ফারুকী সাহেবের সঙ্গ ওর দেখা হয়েছে দু’একবার। তা-ও দূর থেকে।
রাশভারী গলায় ভেসে এল, ‘তুমি তন্ময়ের বন্ধু?’
‘জ্বী’।
‘তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দেখা হয়েছে, ওরা বলেছে তো?’
‘জ্বী’।
‘কি জন্যে এসেছ চট করে বলে ফেলো।’
‘আমি কি এই পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলব?’
ফারুকী সাহেব অসম্ভব গম্ভীর গলায় বললেন, সিট ডাউন।’
‘ধন্যবাদ।
‘কাজের কথা বলো।’
‘আমি আপনাকে কিছু জরুরী কথা বলতে চাই। দয়া করে উত্তেজিত হবেন না।’
‘তোমার হাতে আর মাত্র চার মিনিট আছে।’
‘মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। খুব একটা সময় লাগবে না। যেটা বলতে চাচ্ছিলাম, আমি যতটুকু জানি তন্ময় আপনার একমাত্র সন্তান। নিকট আত্মীয় বলতে তেমন কেউ নেই। ঠিক বলছি তো?’
‘গো অ্যাহেড।’
‘আমি জানতে চাচ্ছিলাম,
আপনি এত টাকা আয় করছেন কার জন্যে?’
ফারুকী সাহেব হিসহিস করে বললেন, ‘নিশ্চয়ই তোমার জন্যে না!’
‘এটা কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না।’
‘এনাফ। তোমার প্রশ্নের উত্তর হলো, এবার আসতে পারো। এতক্ষণ সহ্য করেছি তুমি তন্ময়ের বন্ধু বলে।’
‘জ্বী, আমি তন্ময়ের বন্ধু বলেই, ওর কথা ভেবে বাইরে দুই ঘন্টা লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে মত ভিক্ষুকের মত বসে থেকেছি। আপনি দয়া করে পাঁচ মিনিট সময় দিয়েছেন। কেন জানেন? শুধুমাত্র এ কথাটা বলার জন্যে, তন্ময় মাত্রাতিরিক্ত ড্রাগ নিচ্ছে, ওর আয়ু  ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। আমার ধারণা ছিল এটা সম্ভবত আপনার জানা নেই। এটা ছিল আমার ভুল ধারণা। আমি এবার যাব।’
ফারুকী সাহেব জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন, ‘কি-কি‌, কি বললে তুমি! তন্ময় ড্রাগ-’ জয় পুরোটা শোনার আগেই গায়ের জোরে দরজা খুলে বেরিয়ে এল।


মেয়েটা জয়ের ঝড়ো কাকের মত অবস্থা দেখে অবজ্ঞার হাসি হাসতে গিয়ে ভুলে গেল। বড় সাহেব যে ভঙ্গিতে ছুটে আসছেন এই অভূতপূর্ব দৃশ্য আগে কখনও এ অফিসে দেখা যায়নি। মনে হচ্ছে চকলেটের লোভে ছোট্ট একটা শিশু দৌড়ে আসছে। ফারুকী সাহেব জয়ের হাত আঁকড়ে প্রায় শোনা যায় না এমন গলায় বললেন, ‘প্লিজ, আমার রূমে একটু আসো।’
চেয়ারে জয়কে বসিয়ে ঘুরে নিজের চেয়ারে বসতে দিয়ে টেবিলের কোনায় হোঁচট খেলেন। রিভলভিং চেয়ারে হাত পা ছড়িয়ে এলিয়ে পড়লেন। হাই কুল এসিতেও কপালে সাদা বালুর মত ঘাম জমছে। থেমে থেমে বললেন, ‘ও কখন থেকে ড্রাগ নিচ্ছে?’
‘ঠিক জানি না, আজই জানলাম।’
‘গড-গড! একি শুনছি! আহ-আহ!’
এমুহূর্তে জয়ের এই মানুষটার জন্য কী মায়াই না লাগছে। কোমল গলায় বলল, ‘আপনি কখনও টের পাননি?’
‘নাহ। এটা আমার কল্পনাতেও আসে না!’
‘এখন সবচে’  জরুরী যেটা, ব্যাপারটা খুব ভেবেচিন্তে হ্যান্ডল করতে হবে। বাড়াবাড়ি করলে হিতে বিপরীত হবে।’
‘ওহ গড, আমি এখন কি করব?

‘শান্ত হন, আপনার সহযোগিতা সবচে জরুরি। আরেকটা কথা, আমি যে আপনাকে এসব বলেছি এটা যেন ও ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে। জানলে আমার সঙ্গে হয়তো যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে। এটা খুবই খারাপ হবে।’
‘কি ড্রাগ নিচ্ছে, জানো?’
‘খারাপটাই। পেথেডিন-হেরোইন, ঠিক নেই। যখন যেটা পায়। আর আপনি তো জানেন হেরোইন পর পর তিনবার নিলে চিকিৎসা ছাড়া এটা বন্ধ করা সম্ভব না।’
ফারুকী সাহেব চশমাটা নামিয়ে রাখলেন। ঝাপসা হয়ে আছে, লাগিয়ে রাখার কোন মানে হয় না! কপালের দু’পাশ চেপে বললেন, ‘কিছু মনে করো না, তোমার নামটা?’
‘জয়’।
‘জানো, জয়, ওর মা না থাকাতে এ অবস্থা হয়েছে। স্বীকার করি আমি ভাল বাবা হতে পারিনি। হয়ে গেছি টাকা বানানোর মেশিন। আজও টাকাই বানিয়ে যাচ্ছি। কি লাভ বলো, আমি আর ক’দিন, এসব তো ওর জন্যেই। ও কেন এমন করল, কিসের অভাব ওর? যখন যা চেয়েছে তাই দিয়েছি। কোন সাধ অপূর্ণ রাখিনি। একবার বলল বাবা আমি আর লেখাপড়া করব না। আমি বিরক্ত হলাম। খুব ঝুলাঝুলি করাতে বললাম, ঠিক আছে যা, করিস না। একদিন বলল, বাবা বাইক চালাতে ভাল লাগছে না, টাকা দাও গাড়ি কিনব। আমি বললাম আমাদের তো বেশ কটাই গাড়ি, একটা নিয়ে নে। ও বলল, না আমি লেটেস্টটা কিনব। ওই গাড়ি ক’দিন চালাল। এখন গারাজে পড়ে থাকে। কোন সাধটা ওর অপূর্ণ রেখেছি!’
জয় থেমে থেমে বলল, ‘আসলে ড্রাগ নেয়ার জন্যে নির্দিষ্ট কোন কারণ থাকে না। পারিবারিক জটিলতা ছাড়াও অনেকে সঙ্গ দোষে নেয়া শুরু করে। কেউবা নতুন একটা কিছু করতে গিয়ে ফান হিসেবে শুরু করে। ওর ব্যাপারটা আসলে ঠিক বুঝতে পারছি না। ওর সঙ্গে বহুদিন পর কাল আমার বিয়েতে দেখা হলো তো। এরপর আজ সকালে এলো।’
ফারুকী সাহেব ভাঙা গলায় বললেন, ‘এখন
আমি কি করব?’
‘ড্রাগ অ্যাডিক্টদের কোথায় ভাল চিকিৎসা হয় খোঁজখবর নেন। ওকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে ভর্তি করাতে হবে। ভর্তি না করালে বাইরে থেকে ড্রাগ নেবে, লাভ হবে না কিছু।’
‘বাসায় আছে কি না কে জানে।’
‘দুপুরে আমার ওখানে খাওয়ার কথা ছিল। ড্রাগ যোগাড় করবে বলে চলে গেল। খুব তাড়াহুড়ো করবেন না। দেখি বিকেলে ওর সঙ্গে দেখা করে। আমি আপনাদের বাড়িতে গেলে কিছু মনে করবেন না তো?’


ফারুকী সাহেবের চোখ ভেজা। অসমবয়সী এক যুবকের কাছে এ লজ্জা তাঁকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করল না। চেয়ার ছেড়ে জয়ের হাত ধরে আর্দ্র গলায় বললেন, ‘নো মাই সান, আমি খুব খুশি হব। তুমি আমার এই একটা মাত্র ছেলেকে বাঁচাও।’
‘প্লীজ, শান্ত হন। আমি আমার সাধ্যাতীত করব। তন্ময় আমার পছন্দের মানুষদের একজন। আমি ওকে খুব পছন্দ করি। আপনার মত নিশ্চয়ই মমতা-আমি, মানে-।’
‘ইটস, ইটস অলরাইট, মনটা শক্ত করো। আমরা ভেঙ্গে পড়লে ওর ক্ষতি হবে যে।’
‘আমি তাহলে এখন যাই।’
‘জয়, তুমি যদি দুপুরে আমার সঙ্গে খাও আমার খুব ভাল লাগবে। তাছাড়া তোমার সম্বন্ধে কিছুই জানি না। জানতে ইচ্ছে করছে।’
‘আজ না, অন্য কোনদিন।’
‘জরুরী কোন কাজ আছে?’
‘জ্বী, জরুরী কাজ ঠিক না, মানে-।’
‘তাহলে চলো, একসঙ্গে লাঞ্চ করি।’
‘ইয়ে মানে, ইভা-।’
‘ইভা, ইভা কে?’
‘কাল বিয়ে হলো তো, ও অপেক্ষা করবে।’
‘ওহ হো, তোমার ওয়াইফ, সরি-সরি। তা আগে বলবে তো! তুমি দেখি আচ্ছা ছেলে হে।

‘আচ্ছা, যাই তাহলে।’
‘ও, শোনো শোনে, এক মিনিট। তোমার বাসার ঠিকানাটা বলো তো?’
‘বাসাবোর একদম ভেতরে, আগমন সিনেমা হলের পেছনে। পেঁচানো রাস্তা।’
‘আহ, একটা কাগজে লিখে দাও না।’
‘একদম ভেতরে, মানে ঠিক খুঁজে-।’
ভয় পাচ্ছ, হুট করে হাজির হয়ে যাব?’
‘না-না, কি যে বলেন, ইয়্যু আ মোস্ট ওয়েলকাম।’

জয় অনেক চেষ্টা করল, লাভ হলো না। ফারুকী সাহেব কেবল এগিয়েই দিলেন না, জয়কে প্রায় ঘাড় ধরে গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে ড্রাইভারকে বলে দিলেন জয়কে যেন তার বাড়িয়ে পৌঁছে দেয়।

আগের পর্ব: কনক পুরুষ, ৮: http://www.ali-mahmed.com/2010/08/blog-post_22.html 

কনক পুরুষ: http://tinyurl.com/29uf4s    

Sunday, August 22, 2010

কনক পুরুষ: ৮

পাথর চাপা হৃৎপিন্ড নিয়ে জয় বাসায় ফিরল। এখানে আরেক নাটক হচ্ছে। খালা ইভাকে নিয়ে পড়েছেন। ও বিব্রত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে আছে। খালার দাঁত যেমন উঁচু, মনটা তেমনি নিচু। বিশ্রী ভঙ্গি করে কি সব জিজ্ঞেস করছেন, ‘অ্যাই, অ্যাই মেয়ে তোমার হাত-গা খালি, তোমার গহনা কই?’
জয় ঠান্ডা গলায় বলল, ‘এই মেয়ে, এই মেয়ে করছ কেন, ওর নাম নাই?’
‘তুই এভাবে কথা বলছিস যে! মুরুব্বীর সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলে?

‘কিভাবে কথা বলছি?’

‘কিভাবে বলছিস জানিস না?
‘না, জানি না। বলে দাও।’
‘গহনার কথা জিজ্ঞেস করাতে দোষ হয়েছে, লিস্ট করতে হবে না?’
‘লিস্ট দিয়ে কি হবে?’
‘কি বলছিস তুই! কি কি এল খোঁজ নিবি না?’
‘কি করব খোঁজ নিয়ে, ধুয়ে খাব? ওর জিনিসের খোঁজ ও রাখবে, তুমি আমি কে?’
‘আমি কেউ না! বাড়িতে ডেকে এনে অপমান করছিস?’
‘তুমি যা ভাল মনে করো।’


এ মুহুর্তে খালাকে দেখে মনে হচ্ছে অসহ্য রাগে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘ওই দিন মাত্র তোকে লেংটা দেখলাম, আজ আমাকে তুই-তোকারি করছিস!’
‘খালা, শুধু শুধু কথা বাড়াচ্ছ। কখন তোমাকে তুই করে বললাম।’
‘বলিসনি, বলবি।

আচ্ছা, যখন বলব তখন চড় দিও। 
বলে ফেললে কি করব? কলস ভেঙ্গে ফেললে চড় দিয়ে লাভ কী!’
‘খালা, দয়া করে চুপ করো।’
‘বাইরের একটা মেয়ের জন্যে আমাকে চুপ করতে বলছিস?’
‘এ বাইরের মেয়ে না, একে কলেমা পড়ে বিয়ে করেছি। তুমি যেমন, এ-ও তেমন।’
‘এ আর আমি সমান হলাম! কোথায় আগরতলা কোথায় চৌকির তলা!’


জয় চুপ করে রইল, এ মহিলার সঙ্গে কথা বলা বৃথা। ইভার মুখ সাদা হয়ে গেছে। খালা পাগলের মত হয়ে গেলেন, ‘তুই আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করলি, তোর খালু আজ পর্যন্ত এমন করার সাহস পায়নি!’
জয়ের ধৈর্য্যর বাঁধ ভেঙ্গে গেল। চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘খালু ভাল মানুষটার মাথা তো রাতদিন চিবিয়ে খাচ্ছ। লোকটার পাগল হতে বাকি আছে।

খালা একছুটে রান্নাঘর থেকে জয়ের মাকে নিয়ে এসে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললেন, ‘জাহানারা, দেখ, দেখ তোর ছেলে কিসব বলছে, আমার স্বামী নাকি পাগল। আল্লাগো, এ দিনও দেখার ছিল! অনেক হয়েছে আর না, বানের জলে ভেসে তো আর আসি নাই। ভেবেছিলাম ক’দিন থেকে এর সংসার গুছিয়ে দিয়ে যাব। ঠিক হয়েছে, মুখে ঝাঁটা মরে তাড়িয়ে দিচ্ছে। এই মুহুর্তে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। এক মুহুর্ত না... জানুরে, একটা ট্যাক্সি ডেকে দে।’


জয়ের মা, বলে কয়েও বোনকে রাখতে পারলেন না। খালা যাওয়ার আগে দীর্ঘক্ষণ খালুর সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। প্রত্যেকটা শব্দের সঙ্গে খন্ড খন্ড করে কাঁদলেন। জয় ভয়ে ভয়ে ছিল, খালা না আবার মত বদলে ফেলেন।
ইভা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘তুমি কেন এমন করলে, খালাকে কাঁদিয়ে দিলে।’
‘বেশ করেছি। এ মহিলার মন আবলূস কাঠের মত।’
‘ছি, তুমি আমার জন্যে এমন করলে, মা খালা এরা কি ভাবলেন বলো তো!’
‘খালা কি ভাবলেন এতে কিছুই যায় আসে না। মা কিছু মনে করবেন না। নিজের বোনকে ভালই চেনেন।’
‘ছি, তুমি কিসব করো!’
‘আচ্ছা, এসব বাদ দাও। তন্ময় কিন্তু দুপুরে খাবে না, চলে গেছে।’
‘তুমি আটকালে না, আমি না কত করে বললাম।’
‘বলেছিলাম, শুনল না। ও নিয়মিত ড্রাগ নিচ্ছে, জোগাড় করতে গেছে।’
‘কি-ক-ক্কি বলছ!’
‘হুঁ। খুব খারাপ অবস্থা ওর।’


ইভার অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে এটা ভাবতে যে, এই আমুদে ছেলেটা ড্রাগ নিচ্ছে। জয় এবার গাঢ় স্বরে বলল, ‘যাওয়ার সময় খুব ঘটা করে বলে গেল তোকে অসম্ভব পছন্দ করি। কথাটা বলেই ফেললাম, আর যদি সুযোগ না হয় কোনদিন।’
ইভা এগিয়ে এসে নিঃসঙ্কোচে জয়ের হাত ধরল, ‘তন্ময় ভাইকে একটু বলবে আমার সঙ্গে দেখা করতে?
‘তন্ময়, তুই এটা কি করলি, কিসের অভাব তোর? তুই কী জানিস টাকা-পয়সার কি কষ্ট, তুই কী জানিস! এই আমি, আমি জানি। গত বছর পর্যন্ত কি কষ্টই না করেছি। মাস্টার্স করে ঘরে বসে আছি। চাকরি নেই, বাবার পেনশনের টাকায় চলছে না। এ বছর ছোট ভাইকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়াতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছি। জানো ইভা, আমার এই ভাই তার জীবনের সেরা সময় কাটাচ্ছে বিদেশে, নি:সঙ্গ-একাকী। বড় ভাই হয়ে এ লজ্জা কোথায় রাখি বলো? মুহুর্তের জন্যেও ভুলতে পারি না, দায়িত্ব পালনে আমি অসফল হয়েছি। ওর যাওয়ার সময় আমি হাসিমুখে বললাম, যা দীপু যা, তোকে কোরবানি দিলাম। হাসি হাসি মুখে বলেছিলাম কিন্তু বুক ফেটে যাচ্ছিল।’


জয়ের এতক্ষণে খেয়াল হলো ইভা ওর হাত ধরে আছে। কী কোমল ওর হাত! জয় লজ্জায় লাল-নীল হতে থাকল, হাত ছাড়াবার জন্যে টানাটানি করতে লাগল। ইভা হাত ছেড়ে নিঃশব্দে হাসল। কর্কশ শব্দে টেলিফোন বাজছে। জয় বেঁচে গেল। দ্রুত গিয়ে ফোন উঠালো। ওপাশ থেকে খালুর আমুদে গলা ভেসে এল, ‘লায়েক হয়েছিস, তোর খালাকে কি বলেছিস? টান মেরে আলাজিব ছিঁড়ে ফেলব।’
‘সরি, খালু। আমার না আজ মনটা ভাল নেই।’
‘তোর মন ভাল নেই মানে, ওই জিনিসটা আছে নাকি তোর!’
‘সরি, খালু। ভুল হয়ে গেছে।’
‘আ: ক্যাঁচরম্যাচর বন্ধ কর। এই দজ্জাল মহিলাকে কাবু করলি কি করে?’
‘ইয়ে খালু, খালা খুব রেগেছে নাকি?’
‘রেগেছে মানে, গুন্ডা লাগিয়ে তোকে খুনও করে ফেলতে পারে, বিচিত্র কিছু না। আমাকে বলেছে তোকে ল্যাংটা করে পিটাতে, হা হা হা’
‘বিতিকিচ্চি ব্যাপার হয়ে গেল, খালু।’
জয় রিসিভারটা কানে আরও চেপে ধরল, কেমন শোঁ-শোঁ শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে সাগর তীরে বসে আছে। চিৎকার করে বলল, ‘হ্যালো, খালু, হ্যালো, লাইন ডিসটার্ব করছে, জোরে বলো শুনতে পাচ্ছি না।’
খালূর অস্পষ্ট গলা ভেসে এল, ‘এই শোন, কি কি বলে এই ভদ্র মহিলাকে কাবু করলি সব কাগজে লিখে রাখ। পরে তোর কাছ থেকে জেনে নেব নে।’


লাইন কেটে যেতেই জয় টেলিফোন রেখে হাসল। খালু যে কী ছেলেমানুষ!
‘জানো ইভা, খালুর মত মানুষ হয় না, অথচ এই ভদ্রলোককে খালা যে কি মানসিক অত্যাচার করেন এটা বলে শেষ করা যাবে না। এই সেদিন চাকরানির সাথে খালুকে জড়িয়ে বিশ্রী হইচই করলেন। একদিন কি ভালমানুষের মত মুখ করে বললেন, জয়, তোর খালু আজকাল দেরি করে বাসায় ফিরছে। আমার মনে হয় কোন মেয়ের পাল্লায় পড়েছে। তই একটু খোঁজ খবর নে তো, টাকা পয়সার কথা চিন্তা করিস না। চিন্তা করো, কী ছোট এই মহিলার মন।’
‘তুমি কি চা খাবে?’
‘নাহ, একটু বেরুব। তন্ময়ের ব্যাপারে কি করব বুঝতে পারছি না। দেখি ওর বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারি কি না।’


*কনক পুরুষ, ৯: http://www.ali-mahmed.com/2010/08/blog-post_23.html 
**কনক পুরুষ: http://tinyurl.com/29uf4s

Tuesday, August 17, 2010

কনক পুরুষ: ৭

জয়ের ঘুম ভাঙল পাঁচটা দশে। ভোর হয়-হয়। কী অবাক কান্ড, কাকডাকা ভোরে কখনই ওর ঘুম ভাঙে না। ভোর দেখার সৌভাগ্য অল্পই হয়েছে কিন্তু প্রতিবারই মনে হয়েছে, আহ, বেঁচে থাকা কী আনন্দের!
অবাক হয়ে ভাবল, ও সোফায় কেন; বিছানা কি হয়েছে? বিছানার দিকে তাকিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল, একটা মেয়ে গুটিসুটি মেয়ে শুয়ে আছে, এ কে! মাথা ঝাঁকিয়ে মনে মনে হাসল, কি বোকা, এ মেয়েটার সঙ্গেই তো কাল বিয়ে হয়েছে। ও কেমন গোল হয়ে শুয়ে আছে। ওর কি শীত করছে? সোফার চাদর উঠিয়ে গায়ে দিতেই ইভা ঘুম-ঘুম চোখে তাকাল। কী টলটলে ওর চোখ!
জয় বিব্রত হয়ে বলল, ‘কিছু না, তোমার শীত করছিল সম্ভবত, চাদর দিলাম।’
ইভা চাদর ভাল করে জড়িয়ে উঠে বসল।
জয় বলল, ‘ঘুম হয়েছে?’
‘হুঁ।’
উঁহুঁ, আমার ধারণা তুমি ভাল ঘুমুতে পারোনি। কি ইভা, এখনও আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না?’
ইভা কিছু বলল না, এমনভাবে হাসল যেন একটা সূর্য হেসে উঠল।


জয় কান পেতে কি যেন শোনার চেষ্টা করছে। গেট খোলার শব্দ হচ্ছে মনে হল। জয় বলল, ‘থ্যাঙ্ক গড, বুড্ডি যাচ্ছে তাহলে।’
ইভা অবাক হয়ে বলল, ‘বুড্ডি কে?’
‘অ, তুমি তো জানো না, আমার দূর সম্পর্কের দাদি। আমি ওনাকে সহ্য করতে পারি না। যতবার দেখা হয় ততবার মনে মনে বলি, বুড্ডি-বুড্ডি-বুড্ডি। বলো তো কি জঘণ্য একটা ব্যাপার, ভাবলেই নিজেকে চড় দিতে ইচ্ছা করে। অথচ জানো, আমার দাদি চান আমি হেসে হেসে ওনার সঙ্গে কথা বলি, গল্প করি। ছোটবেলায় কিন্তু ইনি বাচ্ছাকাচ্চা মানে আমাদের মোটেও পছন্দ করতেন না। মা’র কাছে শুনেছি কোনদিন আমাকে কোলে নেননি। একটু বড় হয়ে দাদির পেছনে ঘুরঘুর করলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতেন। বড় হয়ে সম্ভবত এরই ছাপ পড়েছে আমার মধ্যে।’
ইভা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। মানুষটা কেমন হড়বড় করে একগাদা কথা বলছে। অসম্ভব লজ্জিত হলো, বয়স্ক একটা মানুষ সম্বন্ধে বলা কথাগুলো শুনতে ভাল লাগছে না, অথচ এর কথা কান পেতে শুনতে ইচ্ছা করছে।
জয় সচেতন হয়ে লাজুক গলায় বলল, ‘ছি-ছি, কি অবস্থা বলো তো, বাচালের মত কিসব বলছি। এমনিতে আমি কিন্তু খুব একটা কথা বলি না, আশ্চর্য, তোমার সঙ্গে কেন যে বলছি। তোমাকে বিব্রত করে ফেলেছি, সরি।’
ইভার খুব ইচ্ছা হলো বলে, তুমি বলো শুনতে ইচ্ছা করছে। বলতে পারল না। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল, আহ, জীবনটা এত জটিল কেন, যা বলতে চাই বলতে পারি না কেন আমরা? আনমনা হয়ে ছিল বলেই বুক থেকে চাদরটা খসে গেছে। পাতলা রেশমের মত শোবার পোষাকটায় চড়াই উৎড়াই ফুটে উঠেছে। জয় চোখে রাজ্যের মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইল। কী অসহ্য একটা দৃশ্য, তাকিয়ে থাকলে চোখ ধাঁধিয়ে যায় আবার চোখ ফিরিয়ে নিতেও ইচ্ছা করে না। কী কান্ড, ভেতরে কিছু পরেনি নাকি!


লজ্জার শেষ রইল না যখন দেখল ইভা গলা পর্যন্ত চাদর টেনে হাত আড়াআড়ি করে রেখেছে। জয় বিড়বিড় করে বলল, ‘চা খাওয়া দরকার। ইয়ে, তুমি চা খাবে তো, তোমার জন্যে নিয়ে আসি এককাপ।’ লম্বা লম্বা পা ফেলে এগুতে নিয়ে জয় দরজায় হোঁচট খেলো। চশমা ঠিক করে এগুতে গিয়ে আড়চোখে দেখল ইভা ঘুম-ফোলা মুখে হাসি চাপার চেষ্টা করছে। কিচেনে উঁকি দিল, মা ডুমো-ডুমো করে আলু কাটছেন।
‘মা, চা হবে নাকি? অসুবিধে হলে থাক।’
জয়ের মা বিরক্ত গলায় বললেন, ‘থাক মানে, কোনদিন তোকে চা করে দেইনি!
এ ছেলেটা কেমন অদ্ভুত হয়েছে! মা’র সঙ্গেও এর বিনয়ের শেষ নেই। সেদিন চড় দিতে ইচ্ছে করছিল। রাতে চোখ লেগে গিয়েছিল, ফ্রিজে তরকারি-টরকারি সব ছিল অথচ ছেলেটা ঠান্ডা কড়কড়ে ভাত শুধু ডাল মেখে খেয়ে ঘুমিয়ে গেল। পরদিন সকালে থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করেছিলেন: কি রে তুই আমাকে ডাকলি না যে।
ডাকব কি, তুমি ঘুমুচ্ছিলে না!
মরে তো যাইনি, ঘুমিয়ে ছিলাম।
ছি, মা!
চুপ, ফাজিল, তাই বলে তুই না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বি!
কি বলছ, খেলাম না!
জয় আবারও বলল, ‘মা, দু’কাপ বানিয়ো।’
জয়ের মা গরম পানিতে চা পাতা ছেড়ে বললেন, ‘বৌমা উঠেছে নাকি রে?’
‘হুঁ , ওর চা-টা বুয়াকে দিয়ে পঠিয়ে দিয়ো।’

‘তুই নিয়ে যা, ও বাথরুম পরিষ্কার করছে।’
‘থাক তাহলে, ওকে দিতে হবে না, কেবল আমার চা-টাই দাও।’
‘কি বলছিস পাগলের মত! এই না বললি বৌমা চা খাবে?’

বলেছি নাকি, ভুল বলেছি।
পেছন থেকে ইভার গলা ভেসে এল, ‘মা, আমার চা-টা আমাকেই দিন।’
জয় বিচিত্র ভঙ্গিতে অতি দ্রুত ওখান থেকে বেরিয়ে গেল। পেছনে পড়ে রইল ইভার হাসি এবং মার বিস্ময়ভরা চোখ...। 

*আগের পর্ব: http://www.ali-mahmed.com/2007/07/blog-post_02.html 

*কনক পুরুষ: http://tinyurl.com/29uf4s

Monday, August 9, 2010

কনক পুরুষ: ৬

তন্ময় তার রূমে ঢুকে রায় দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘তোর পুতুপুতু ভাব আমার একদম পছন্দ না। তোর মনে কু আছে।’
‘আচ্ছা যা, আমার মনে কু আছে। এখন একটা সিগারেট দে।’
তন্ময় প্যাকেট ছুঁড়ে বলল, ‘দাগ দেয়া সিগারেটগুলো কিন্তু চরস ভরা।’
‘মাই গড, বলিস কী! দাগ এলোমেলো হয়ে যায়নি তো আবার?’
‘একটা খেয়ে ফেললে তো আর পটল তুলবি না।’
জয় খুব সাবধানে একটা দাগ ছাড়া সিগারেট বের করে ধরাল। অখন্ড মনোযোগ রিঙ বানাতে চেষ্টা করল। তন্ময় চোখ ছোট করে বলল, ‘তুই হঠাৎ এলি যে। আর তো কখনও আসিসনি?’
‘ইচ্ছা করল, আসলাম। কেন বাংলাদেশে এমন কোন আইন পাশ হয়েছে তোর এখানে আসা যাবে না?’
‘আরে নাহ, আমি ভাবছিলাম, মাত্র বিয়ে করলি, বউ ছেড়ে বেরিয়ে এলি যে।'

'ছাগল, বিয়ে করলে লোকজন কী ঘর আর ছেড়ে বার হয় না!'

'সৌদিদের একটা জিনিস আমার খুব পছন্দ, জানিস। বিয়ের পর জামাই-বউ সাত ঘর ছেড়ে বেরোয় না। আনুষাঙ্গিক সবকিছু ওদের ঘরে পৌঁছে দেয়া হয়। আমি হলে তাই করতাম।’
জয় হাসি চেপে বলল, 'কোত্থেকে এই সব আজগুবি খবর পাস!'
‘সত্যি। শোন, বউকে বিছানা ছাড়তেই দিতাম না। আমরা দুজন-দুজন দু’জনার। বিছানায়-’
‘আহ, তন্ময়!’


তন্ময় অবিকল কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করে উঠল, ‘শালা, লজ্জায় মরে যাচ্ছে। ন্যাকামী, নাক নিপলে দুধ বেরোয়। বউয়ের সঙ্গে শুতে লজ্জা করে না, শুনলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়।’
জয় লাল নীল হয়ে বাধো বাধো গলায় বলল, ‘ওসব কিছু আদৌ হয়নি আমাদের এখনও।’
‘কি-ক-কি বললি তুই!’
‘যা শুনেছিস তাই।’
‘এটা বিশ্বাস করতে বলছিস?’
‘হুঁ।’
‘তোর যন্ত্রপাতি ঠিক আছে তো? আমার ধারণা ঠিক নেই।’
‘তোকে বলে মহা ভুল করেছি, সব সময় কুৎসিত কথা। শুনতে ভাল লাগে না।’
তন্ময় অবিকল গরুর মত বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর বলল, ‘এ রকম হলো কেন?’
‘আমি তোর সঙ্গে কথা বলব না।’
‘প্লীজ, বল না।’
জয় কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, ‘বিয়ের রাতে ও বলল, “আপনার পায়ে পড়ি, আমাকে ছোঁবেন না।” আমি সোফায় শুলাম। এই আর কি।’
‘এই!’
‘হুম। ওর সম্ভবত কিছু সমস্যা আছে। কিছুটা আঁচ করতে পারছি অবশ্য।’
‘জয়, লিখে রাখ, এক নম্বর গাধা পৃথিবীতে আর নাই। যা আছে সব দু’নম্বর। একটাই আছে, সে তুই। বললাম, লিখে রাখ।’
‘ক্যাঁচক্যাঁচ করিস না, লিখতে হবে না; যা তোরটাই ঠিক।’


জয় খানিকটা উদ্বিগ্ন ছিল, সমস্যা কি এটা তন্ময় জিজ্ঞস করে বসবে না তো আবার। না করাতে বেঁচে গেল। ও কখনোই বলতে পারত না। তন্ময় চা’র কথা বলতে ভেতরে গেলে জয় চারপাশে নজর দেয়ার সময় পেল। রাজ্যের জিনিসপত্রে ঠাসা, এগুলোর সম্ভবত সৃষ্টিছাড়া দাম। কিন্তু যে জিনিসটা যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই। মেঝেতে সুন্দর একটা ডায়েরী গড়াগড়ি খাচ্ছে দেখে হাতে নিয়ে রেখে দিতে গিয়েও কি মনে করে পাতা ওল্টাতে লাগল। একজায়গায় চোখ আটকে গেল। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা-
‘বললে নিমিষেই হও
অপাপবিদ্ধ ভূমিষ্ঠ শিশু আমি।
বললে হোক আলোকিত-
চারদিক ফুলে ছেয়ে গেল সব।
বললে কি কুৎসিত আনন্দ
শিশুটি কাঁদল শিশির-অঝোরে।
বললে হাই চেপে: দূর হ,
নিজের লাশ কাঁদে বয়ে-
তুমিই সব, আমি কিছু না।’
জয় কবিতা-টবিতা বোঝে না তেমন। বুঝতে চেষ্টা করছে তন্ময় কি বিশেষ কোন কারণে এটা টুকে রেখেছে। এসবে ওকে মাথা ঘামাতে কখনও দেখেনি।
তন্ময় চারতলা ট্রলিতে করে দুনিয়ার সব খাবার নিয়ে এলো। একটা দৈত্য কুঁজো হয়ে ঠেলাগাড়ির মত একটা জিনিস ঠেলছে, দেখার মত ব্যাপার বটে। জয় হাসতে হাসতে বলল, ‘এত খাবার, ফেরি করতে বেরুবি নাকি!’
তন্ময় কিছু বলল না, কি যেন ভাবছে।
‘কিরে, কোন সমস্যা?’
তন্ময় গম্ভীর হয়ে বলল, ‘বুঝতে পারছি না। আমার মা’র স্বামী কি এক ভঙ্গিতে যেন আজ তাকাচ্ছে। দেখে হার্টবিট মিস হচ্ছে।’
‘ছি, তন্ময়, ছি! মা’র স্বামী এই সব কি!’
‘আরে এ বলে কী! হুশ কুত্তা, হুশ! তো যেটা বলছিলাম, মা’র স্বামী-।’
‘আমি উঠি, তন্ময়। ’
‘আহ, রাগ করছিস কেন। আচ্ছা যা, আমার বাব। তো ইনি দুপুরে ফিরে অফিসে আর যাননি, কি রকম অস্বাভাবিক আচরণ করছেন।’
‘অস্বাভাবিক আচরণ মানে?’
‘এই ধর। কি করে তোকে বোঝাই, হিন্দি ছবিতে আমরা দেখি না ভাল বাবারা সন্তানদের সঙ্গে বন্ধু-বন্ধু খেলা খেলেন। ওই রকম একটা কিছু আর কি।’
‘এটাকে অস্বাভাবিক আচরণ বলছিস কেন!’
‘বলছি। তুই খাবারে হাত লাগা। যা পারা যায় শেষ করে ফেলতে হবে, নইলে নষ্ট হবে।’
জয় বলল, ‘এত খাওয়া সম্ভব নাকি? আর নষ্ট হবে কি, তুলে রাখলেই হয়।’
‘ধুর, বেঁচে যাওয়া খাবার তুলে রাখলে ভুঁইফোড় বড়লোকদের মান থাকে নাকি। ফেলে দিতে হয়।’
‘ফেলে দিবি?’
জয়ের মনে হলো শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। অসহ্য রাগে ইচ্ছে করছে সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। তন্ময় ওর বিবর্ণভাব লক্ষ করে বলল, ‘এটা শুনে তোর খুব রাগ হচ্ছে? মনে হচ্ছে না আমাকে খুন করে ফেললে আরাম পাবি?’
‘হ্যাঁ, হচ্ছে।’

‘এটাই সত্য, মিথ্যা বলতে আমার ভাল লাগে না।’

জয় কেবল এই কথাটার জন্যে মনে মনে ওকে ক্ষমা করে দিল। অবশ্য একে ক্ষমা না করেও উপায় নেই। বদরঙ বদমজা একটা জিনিস চিবাতে চিবাতে বলল, ‘হ্যা রে, তুই দশজনের চেয়ে অন্যরকম হলি কেন রে?’
‘অন্যরকম মানে কি, মানুষের মত মনে হয় না? এই, এই দেখ, এটা হাত। এটা পা। আর এইটা হলো গিয়ে- থাক, তুই আবার রেগে যাবি। তোর তো আবার শরীরে রাগের উথাল পাতাল ঢেউ।’
‘তোর সঙ্গে কথা বলাই সমস্যা। ভাল কথা, তোর ডায়েরিতে দেখলাম কিসব লিখে রেখেছিস, “বললে নিমিষেই হও”।’
‘লিখে রেখেছি বেশ করেছি, তো সমস্যাটা কি। চায়ে ক’চামচ চিনি দেব?’
‘কম কম করে এক চামচ দে।’
‘তুই শালা ডায়বেটিস রোগী নাকি।’
‘আবার আজেবাজে কথা বলছিস! ভাল করেই জানিস আমার ডায়বেটিস নেই।’

'থাকবে কোত্থেকে! তোর তো যন্ত্রই নেই। হা হা হা।’
জয় চুপ করে রইল। এর সঙ্গে কথা বলার মানে হয় না। কথা বললেই কথার পিঠে কথা বলবে। তন্ময় বিশাল মগে এমন ভঙ্গিতে লম্বা লম্বা চুমুক দিচ্ছে, মনে হচ্ছে চা না সরবত খাচ্ছে। অথচ একই রকম চায়ে জয় মুখ দিয়ে জিব পুড়িয়ে ফেলেছে। এর তাড়াহুড়া দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে আর বিলম্ব নেই। 'লাস্ট সাপার'-এর মত এটাও ‘লাস্ট টি’।


তন্ময় রকিং চেয়ারে পা উঠিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে দোল খেতে খেতে বলল, ‘আমার মা’র স্বামী- আহা, ওভাবে চোখ লাল করে তাকাসনে। আমার বাবার মনে হয় মাথার ঠিক নেই, বুঝলি। আমার সঙ্গে যে লোক গুণে গুণে কথা বলে নোটবুকে লিখে রাখে, কোন মাসে দু’একটা কথা বেশি বললে অন্য মাসে কম বলে পুষিয়ে নেয়। ওরিআল্লা, আমার চক্ষু তো চড়কগাছ। কী কান্ড, খাওয়ার পর থেকে অনর্গল কথা বলছে আমার সঙ্গে। কথা বলে মনে হয় খুব আরাম পাচ্ছে। নমুনা দেই:
‘বাবা বললেন, তন্ময়, দেশটা যাচ্ছে কোথায়।
আমি বললাম, কই, যাচ্ছে না তো কোথাও। আগের জায়গাতেই আছে।
বাবা দেশ কোথায় যাচ্ছে এ নিয়ে যে মাথা ঘামান এটা আমার জানা ছিল না। আর এ নিয়ে সুযোগ্য পুত্রের সঙ্গে ডিসকাস করবেন এটা অস্টম আশ্চর্য গোছের কিছু একটা। ওনার ধারণা ছেলের সঙ্গে বেশি মাখামাখি হলে বাবারা বাবা থাকবেন না, হাবা হয়ে যাবেন। তারপর বাবা বললেন, তা না, কিন্তু দেশটা যাচ্ছেটা কোথায়!
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, জ্বী, একবার বলেছি, আগের জায়গায়ই আছে। দেখ দেখি কান্ড, মাস তিনেকের কথা। আমার এক বন্ধু, বুঝলি, বহুদিন ছুটি পায় না। আমাকে অনুরোধ করল, আমি যেন টেলিগ্রাম করি, ছুটি পেতে সুবিধে হবে। ওর হাতে টেলিগ্রাম গিয়ে পৌঁছল তিনদিন পর। চিন্তা কর, অথচ অর্ডিনারি চিঠি চট্টগ্রাম পৌঁছে এক দিনে।
আমি বললাম, চিন্তা করার সময় কই। সহজ বুদ্ধি হলো: অর্ডিনারি চিঠির ভেতর টেলিগ্রাম ভরে পাঠিয়ে দেয়া। বাবা অবাক হলেন, চিঠি দিলেই হয়, এর ভেতর টেলিগ্রাম দেয়ার মানে কী।
অ, এইটা বুঝলে না। ধরো, তুমি চিঠিতে লিখলে আমার এখন-তখন অবস্থা। বাতাসের আগে আসো। যে চিঠিটা পাবে সে কি খুব একটা গুরুত্ব দেবে, না অন্যরা? কিন্তু চিঠি খুলে এই কথাটাই টেলিগ্রামে লেখা থাকলে। ঢিং । সেই লোক তোমার প্রিয়জন হলে প্যান্ট নষ্ট করে ফেলবে না? অবশ্য তুমি বেঁচে গেছ, তোমার তেমন কেউ নেই।

জানিস জয়, অন্য সময় এভাবে কথা বললে বাবা তুলকালাম করে ফেলতেন, কাঁচা ডিম মাথায় রাখলে সেদ্ধ হয়ে যেত। আজ কেমন নির্বিকার ভঙ্গিতে বাসে রইলেন।’

জয় বিব্রত গলায় বলল, ‘বাবাকে নিয়ে কেউ-।’
‘জানি, জানি, তুই কি বলবি। বাবার সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলে না, এই তো? তাদের বাবারা কি নিজ থেকে ছেলেকে একবার হ্যালো বলারও প্রয়োজন বোধ করে না। মাসের পর মাস দেশের বাইরে পড়ে থাকে! ছেলে কোথায় যাচ্ছে কি খাচ্ছে-।’
‘ভুল তো সবাই করে। তাই বলে তোর মত ড্রাগ নেয় না। এভাবে আত্মহত্যা করে না।’
‘আসলে তোকে ঠিক বোঝাতে পারব না। ড্রাগ নিলে কি পরিণতি হবে এটা যে জানতাম না এমন না। তখন কি মনে হত জানিস, আমি যেভাবে বেঁচে আছি এটা কোন বেঁচে থাকা নয়। এভাবে না মরে ওভাবে মরলাম, কি আসে যায়।’
‘যা হয়েছে হয়েছে, চিকিৎসা হলেই সেরে উঠবি।’
তন্ময় উদাস হয়ে বলল, ‘কি লাভ, এই তো ভাল।’
জয় এবার রাগী গলায় বলল, ‘মামদোবাজী করবি না। এ পৃথিবীতে নিজ থেকে আসিসনি, মরে যাওয়ার কোন অধিকার তোর নাই। তোর ওপর সৃষ্টিকর্তার, তোর বাবারও অধিকার আছে।’


তন্ময় রাগে এমন লাফিয়ে উঠল জয় ভয় পেয়ে আধ হাত পিছিয়ে গেল। তন্ময় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে চেঁচাচ্ছে, ‘তুমি শালা এ দেশের প্রধানমন্ত্রী না প্রেসিডেন্ট, খুব যে ভাষণ দিচ্ছ। আমাকে পৃথিবীতে পাঠানোর আগে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল আমি আসতে চাই কি না? হাত পা ধরে সাধছিলাম, পাঠাও-পাঠাও? কেউ বলেছিল, আমাকে তুমি যে পৃথিবীতে পাঠাচ্ছ, এই হলো এর অবস্থা। অ্যাহ, অধিকার! ইচ্ছের বিরুদ্ধে এসেছি, ইচ্ছা হলে থাকব, না হলে থাকব না।’
‘প্লীজ, তুই-।’
‘শান্ত হব? আমার মাথায় খুন চেপে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে তোর মাথাটা ফট করে-।’
‘আজই বলেছিস দু’তিনবার, ডিমের খোসার মত ভেঙে ফেলবি।’
বিদায় নেয়ার সময় জয় তন্ময়ের হাত ধরে আবেগঘন গলায় বলল, তন্ময়, একটা জিনিস চাইব, দিবি?’
‘কি পাগল, না জেনে প্রমিজ করব কি! তুই আমার ওইটা চাইলি, দিয়ে দিতে হবে? হা হা হা।’
‘ফর গড সেক, তন্ময়, কখনও তো সিরিয়াস হ’!’
‘ধানাই-পানাই বাদ দিয়ে কি বলবে বলো, চান্দু।’
জয় গোঁয়ারের মত বলল, ‘তুই আগে প্রমিজ কর। ’
‘আচ্ছা, প্রমিজ করলাম। এবার বল।’
‘তোর চিকিৎসার ব্যাপারে যা করার আমি করব। তুই টুঁ-শব্দও করবি না।’
তন্ময় অন্যরকম গলায় বলল, ‘লাভ নেই রে, আমি শেষ।’
‘এসব বুঝি না, তুই কথা দিয়েছিস । আর শোন, ইভা বলেছে তোকে যেন অবশ্যই বলি ওর সঙ্গে দেখা করতে। কাল আয়।’
‘তুই থাকলে যাব, না কি না থাকলে যাব, এটা বলে যা। হা হা হা।'


*কনক পুরুষ, ৫: http://www.ali-mahmed.com/2010/08/blog-post_08.html 

**উপন্যাস, কনক পুরুষ: http://tinyurl.com/29uf4sq  


Sunday, August 8, 2010

কনক পুরুষ: ৫

জয় তন্ময়দের বাড়ি দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল। এটাই কী এদের বাড়ি! এ দেখি হুলস্থূল ব্যাপার। মাত্র দু’জনের এ রাজ প্রাসাদের প্রয়োজন কি? যে দেশের অধিকাংশ লোক খোলা আকাশের নিচে রাত কাটায়, সে দেশে মাত্র দু’জনের জন্যে এ জিনিসটার মানে কি! এই বাড়িটায় ক’টা রুম কে জানে। গোটা ত্রিশেক হলেও একেকজনের জন্যে পনেরোটা করে, কোন অর্থ হয়! আমি এক এক কাঠি ওপরে, আমারটাই সেরা, আমার মত কারও নেই, এই-ই কি কারণ?

বিশাল গেট বন্ধ। ডানপাশে ছোট্ট গার্ডরুম। পুরোদস্তুর পোশাকপরা চোয়াড়ে টাইপের এক লোক এমন ভঙ্গিতে বসে আছে, এখুনি বুঝি গোলাগুলি শুরু হয়ে যাবে। কাউবয়দের মত আবার কায়দা করে পিস্তল ঝুলিয়েছে। সামনের টেবিলে টকটকে লাল ইন্টারকম।
জয় অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ইয়ে, এটা তন্ময়দের বাসা তো?’
লোকটা কথা বলে কৃতার্থ করছে এমন ভাব করে বলল, ‘ইশতিয়াক সাহেবের কথা বলছেন কি?’
জয় একটু থমকাল। গার্ড শ্রেণীর লোকরা এভাবে গুছিয়ে কথা বলে ওর জানা ছিল না। থেমে থেমে বলল, ‘হ্যাঁ, ওর ডাক নাম তো তন্ময়।’
‘ডাক নাম টাম কি, ভাল নাম বললেই হয়।’
‘আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছিলাম।’
‘উনি কি বলেছেন আপনাকে আসতে?’


সামনের রেজিস্টারে চোখ বুলিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, ‘কই, কেউ দেখা করবে এরকম কোন নোট তো দেখতে পাচ্ছি না?’
জয়ের গা রাগে জ্বলে যাচ্ছে। রাগ চেপে বলল, ‘আমি বলিনি দেখা করতে বলেছে। আপনি বলুন ও আছে কি না।’
‘আরে, আপনি তো বড় ঝামেলা করছেন, উনি আছেন কিনা বলতে পারছি না।’
জয়ের মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে। পয়সাঅলারা অন্যদের অপমান করার কত যে ফন্দি-ফিকির বের করেছে এই ইয়ত্তা নেই। ছোট্ট নি:শ্বাস ফেলে ভাবল, তন্ময়ের জন্যেই চলে যাওয়া উচিত হবে না। রূঢ় গলায় বলল, ‘আমি তন্ময়ের বন্ধু। দেখুন ও বাসায় আছে কিনা। ও দেখা করতে না চাইলে যাব।’

লোকটা শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কি যেন ভাবল। ইন্টারকমে ভেতরে তার সমপর্যায়ের কারও সঙ্গে চার-পাঁচবার শুধু হুঁ-হুঁ করল। কথা শেষ করে চেয়ার পেছনে হেলিয়ে বেশ ক’বার দোল খেয়ে বলল, ‘ঘুমাচ্ছেন।’
‘ওকে একটু খবর দিলে-।’
‘ঘুম না ভাঙা পর্যন্ত খবর দেয়া যাবে না।’

 'তাহলে এখন আমি কি করব?'

‘কি করবেন তার আমি কি জানি। পরে আসেন।’
‘আমি তাহলে এখানে বসে অপেক্ষা করি?’
‘এখানে অপেক্ষা করবেন কি, বাইরে থেকে ঘুরে আসেন।’

জয় রাগে জ্বলতে জ্বলতে একবার ভাবল জিজ্ঞেস করে দেখবে ফারুকী সাহেব আছেন কিনা। ভাবনাটা বাতিল করে দিল। তন্ময় ওর বাবার সঙ্গে ওকে দেখে ফেললে দুয়ে-দুয়ে চার মিলিয়ে ফেলবে।
আচ্ছা, এ মুহূর্তে ওকে কি গ্যাং স্টারদের মত দেখাচ্ছে? অলক্ষে মুখে হাত বুলালো, আজ অবশ্য শেভ করা হয়নি। ও যখন শেভ করবে ভাবছিল তখন বাথরুমে ইভা ঢুকে গেল, আধঘন্টা লাগিয়ে গোসল করল। পরে আর শেভ করার কথা মনেই রইল না।
গার্ড লোকটার ভাব দেখে মনে হচ্ছে গোটা বিশ্ব এর পদতলে। এ সম্ভবত অপরিচিতদের সঙ্গে জঘন্য আচরণ করে সুখ পায়। কে জানে, একে হয়তো রাখাই হয়েছে এসব শিখিয়ে।
‘দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন, যান ঘুরে আসেন।’


জয় আর একটাও কথা না বলে বেরিয়ে এলো। বিড়বিড় করে বলতে থাকল, তন্ময়ের সঙ্গে দেখা না করে যাব না-যাব না। আশেপাশে একটা চা-র দোকানও নেই। এক কাপ চা খেয়ে অনেকক্ষণ সময় কাটানো যেত। সিগারেট ধরিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকল। ঘড়ি দেখল, প্রায় চারটা। চারটা বিশ পর্যন্ত হেঁটে ফিরে আসবে, এরিমধ্যে সাড়ে চারটা বেজে যাবে। তখনও তন্ময়ের ঘুম না ভাঙলে আবার ‘কম্বল প্যারেড’।  বারিধারার এ পাশে চারদিকে মহা উৎসাহে কন্সট্রাকশনের কাজ হচ্ছে। এসব বিলাসবহুল বাড়ি শেষ না করেই অনেকে মারা যাবে। কেউবা কাজ শেষ করতে গিয়ে গোল্ড স্মাগলার হয়ে যাবে। এ দেশ এখন কোটিপতি বানানোর মেশিন  হয়ে গেছে। পাকিস্তান আমলে শুনত বাইশ পরিবারের কথা। চুরাশির দিকে জানল, চারশো জন। ওই দিন পত্রিকায় পড়ল, গত বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী কোটিপতির সংখ্যা আঠারোশো জন। আরও কত আছে কে জানে!
এদের মধ্যে কি পঞ্চাশ জনও পাওয়া যাবে যে সৎ উপায়ে কোটিপতি হয়েছে? সৎ থেকে কি আদৌ সম্ভব? একজন লোকের বেঁচে থাকার জন্যে কত টকা প্রয়োজন? পাশ থেকে একজন রিকশাঅলা জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইজান, যাইবেন?’
জয় নিঃশব্দ হাসিতে মুখ ভরিয়ে মাথা নাড়ল। লোকটা যেতে যেতে ফিরে তাকাল। অপুষ্ট কালো মুখে কৃতজ্ঞতা চুঁইয়ে পড়ছে। এরা কত অল্প পেয়ে তুষ্ট হয়, সুখী হতে যেটা প্রথম শর্ত। এরা কি সুখী? কে জানে!


জয় ভাবল, এদের সম্বন্ধে আমরা কত কম জানি! ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে দেখি আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় অথচ সংখ্যায় এরাই বেশি, এদের সম্বন্ধে কিছুই জানা হয় না। লেখকরা এদের নিয়ে লিখতে গিয়ে এমন জটিল করে লিখবেন, পাঠক আগ্রহ নিয়ে পড়বে না। এটা সম্ভবত এসব লেখকরা ইচ্ছা করেই করেন। আর্ট ফিল্মগোছের কিছু একটা বানাতে গিয়ে লেজে-গোবরে করে ফেলেন।
চারটা পঁচিশ। জয় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ফিরতে লাগল।
গার্ড হড়বড় করে বলল, ‘কোথায় গেছিলেন? কে খোঁজ করল ছোট সাহেব জানতে চাইছিলেন। নাম বলেন নাই কেন?’
জয় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘জিজ্ঞেস করেন নাই, সেজন্য বলিনি।’
‘কি নাম আপনার?’
‘আপনাকে বলার প্রয়োজন দেখি না, তন্ময়কে দিন কথা বলব।’
গার্ড নিতান্ত অনিচ্ছায় রিসিভারটা এগিয়ে দিল।
‘তন্ময়, জয় বলছিলাম।’
‘ওরে হারামজাদা, তুই!’
‘থ্যাঙ্ক গড, তোর ঘুম ভাঙল তাহলে!’
‘মানে, এখুনি এসে তুই জানলি কেমন করে রে বেটা!'

'এইমাত্র না, চারটায় এসেছি। গার্ড বলল, তুই ঘুমিয়ে আছিস এখন ডাকা যাবে না। এখানে অপেক্ষা করতে চাইলাম, নিষেধ করল। ভবঘুরের মত রাস্তায় ঘুরে এইমাত্র ফিরলাম। এই সব শিখিয়ে লোকজন রাখিস নাকি?’
ওপাশে কবরের নিস্তব্ধতা। জয় উঁচু গলায় বলল, ‘হ্যালো, তন্ময়, হ্যালো।’
তন্ময় হিমশীতল গলায় বলল, ‘গার্ড যে বলল একজন দেখা করতে চাইছিল, সে তাহলে তুই। হাত দিয়ে দেখ তো তোর চোখে চশমা আছে কিনা?’
জয় বিরক্ত হলো, ‘আজেবাজে কথা বলছিস কেন!’

‘খামোশ শুয়ার! হাত দিয়ে দেখ চশমা আছে কিনা!'
‘হাত দিয়ে দেখতে হবে না, আছে। ঘুমানোর সময় ছাড়া সব সময়ই পরি।’
‘তুই যখন গার্ডের সঙ্গে কথা বলছিলি তখনও কি চশমা ছিল?’
‘আহ তন্ময়, কি ছেলেমানুষী, বললাম না ঘুমানোর সময় ছাড়া...!’
‘চোপ রাও, শুয়ার কাহিকা, যা বলেছি তার উত্তর দে।’
‘আরে পাগল, আমি কি চশমা ছাড়া কিছু দেখি? ছিল, তো কি হয়েছে?’
‘হয়নি কিছু। কেউ খোঁজ করছে জেনে আমার মনে হলো তুই হতে পারিস। কেউ তো আর আসে না। শুয়োরের বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করলাম, নাম বলতে পারল না। জিজ্ঞেস করলাম চোখে চশমা ছিল কিনা, কুত্তার বাচ্চা বলল, ছিল না।’
‘বাদ দে তো এসব।’
তন্ময় গরগর করে উঠল, ‘একচুল নড়বি না, জাষ্ট লাইটপোস্ট। আমি আসছি।’


জয় আড়চোখে দেখল লোকটা কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে, এপাশের কথাগুলো শুনেছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, ‘বসেন এখানে।’
জয় বসল না। দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করতে লাগল। দড়াম করে গেটের ছোট খুপরি আছড়ে মারার শব্দ হলো। ছোট হাফপ্যান্ট, ঢোলা গেঞ্জিপরা তন্ময়কে দেখে এ মুহূর্তে অবিকল বাংলা ছবির দৈত্য লাগছে। পোশাক-আশাক অন্যরকম এই যা। গেঞ্জিটা কোত্থেকে জোগাড় করেছে কে জানে! দেখে মনে হচ্ছে মশারীতে দু’টা হাতা লাগানো হয়েছে। হাসি পাচ্ছে। হাসতে গিয়েও হাসল না। দৈত্যর ভাবসাব সুবিধের না। চোখ মুখ দিয়ে ভাপ বেরুচ্ছে।
‘এই, গার্ডের বাচ্চা গার্ড, এর চোখে চশমা দেখা যাচ্ছে?’
‘ভুল হয়ে গেছে, স্যার।’
‘ভুল হয়েছে বলছিস, ভাল। আমাকে ডেকে দেস নাই কেন?’
‘স্যার, ভু-।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, এটাও তাহলে ভুল হয়েছে।’
এর কান্ড কারখানা দেখে জয় বিব্রত হয়ে বলল, তন্ময়, বাদ দে তো।’
‘চোপ! কথার মাঝে কথা বললে ফট করে মাথাটা ভেঙে ফেলব। তো, গার্ড সাহেব, এ এখানে অপেক্ষা করতে চেয়েছিল, হাঁকিয়ে দিলি কেন?’
গার্ড তো-তো করে বলল, ‘সা-স্যার, অপরিচিত লোক... আমার সঙ্গে আর্মস আছে, সিকিউরিটির একটা ব্যাপার-।’
‘এ তোকে বলে নাই, এ আমার বন্ধু?’

‘বলেছেন, স্যার, আপনি মানে আমি ভাবলাম-।’
তন্ময় ঘর কাঁপিয়ে বলল, ‘ভেবেছেন সিকিউরিটি তো? এই আর্মস আমি তোর পেছন দিয়ে ঢুকিয়ে দেব। তাহলে দেখবি সিকিউরিটি ঠিক থাকবে।’
জয় গায়ের জোরে সরিয়ে নিয়ে এলো। একটা দৈত্যকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিয়ে আসা চাট্টিখানি কথা না, প্রচুর কাঠ-খড় পোহাতে হলো। এরই মধ্যে ঘেমে গোসল হয়ে গেছে। তন্ময় পাগলের মত বিড়বিড় করছে, ‘বানচোত, আর্মস-এ মরিচ মাখিয়ে দিলে টের পাবি!’
‘ছি, কিসব বলছিস, এই সব বিশ্রী কথা বলতে নেই। তাছাড়া আমাকে চেনে না ঠিকই তো বলেছে। শুধু ধুধু লজ্জায় ফেলে দিলি। ছি!’
এবার রাগ গিয়ে পড়ল জয়ের ওপর। তন্ময় হিসহিস করে বলল, ‘তোকে আমার পছন্দ না। তুই মেয়েমার্কা ছেলে, আরবের শেখরা...।’
জয় হাসি চাপল। ‘আজ সকালেই একবার বলেছিস। আমার মনে আছে, লালা ঝরবে। এবার দয়া করে ঠান্ডা হ।’

দৈত্যটার ঠান্ডা হওয়ার কোন নমুনাই দেখা যাচ্ছে না। থেকে থেকে এর গা কাঁপছে। একে আটকে রাখতে জয়ের বেগ পেতে হচ্ছে।

*কনক পুরুষ, ৬: http://www.ali-mahmed.com/2010/08/blog-post_09.html

Friday, July 30, 2010

কনক পুরুষ: ৪

ইভা বিরক্ত হয়ে টিভি অফ করল। সিএনএন-এর অনুষ্ঠান হচ্ছে। নিউজ আর নিউজ, বিরক্তিকর। ক্লিনটন গোদা গোদা পা ফেলে দৌড়াচ্ছে, ক্যামেরাও দৌড়াচ্ছে। ক্লিনটন ক্যানের জুস খাচ্ছে, চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে, বোকা বোকা হাসি হেসে ফাটা গলায় গাঁ গাঁ করছে; আরিজোনায় বৃষ্টি হবে কি না এটা ঘনঘন জানানো হচ্ছে, যেন আরিজোনার বৃষ্টির আশায় আড়িখোলার লোক উদগ্রীব হযে বসে থাকে! 
পরিবারের সবাই মিলে ‘শো বিজ’ 'স্টাইল'-এর অ্যাড দেখে কি করে কে জানে! ‘স্টাইল’-এর মডেলদের বুক কতভাগ ঢাকা আর কতভাগ খোলা এ নিয়ে থিসিস সাবমিট করা যেতে পারে। একেকজনের কী হাঁটা, কোমর একবার একহাত ডানে চলে যাচ্ছে আরেকবার দেড় হাত বাঁয়ে।

ইভা বিস্মিত হলো, জয়ের কালেকশনে দেখি প্রচুর বই। এসব বই পড়ল কখন! অডিও ক্যাসেটই হবে তিন চারশোর কম না। ডায়েরি দেখছে একুশটা। ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখল, একেকটায় একেক রকম বিষয়। কোনটায় বিজ্ঞান বিষয়ক তথ্য কোনটায় মজার মজার সব কথা, কোনটায় বা বিচিত্র সব তথ্য। তিনটা ডায়েরির পুরোটাই হলো পেপার কাটিং। সব ধুলোয় মাখামাখি।
শাশুড়ীর কাছে একটা ময়লা কাপড়-টাপড় চেয়েছিল।
তিনি বলেছিলেন, কাপড় দিয়ে কি করবে, বৌমা?
মা, ধুলায় দেখেন না কি অবস্থা!
‘সাবধান, বৌমা, ও কাজ করো না। আমি পরিষ্কার করতে গেলে তেড়ে আসত যেন গুপ্তধনে হাত দিয়ে ফেলেছি।
মা, ক্যাসেটগুলো ধুলো পড়ে নষ্ট হবে তো।
হোক, তুমি এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। ও একটা পাগল-ছাগল। একবার কি হলো জানে, ওর চশমা ভেঙ্গে গেল। বাড়তি চশমা নাই। নতুনটা একদিন পর পাওয়া যাবে। ডানদিকে মাইনাস সাড়ে সাত, বামেরটা সাত। সন্ধ্যায় দেখি দিপুর খেলনা বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে মগ্ন হয়ে টিভি দেখছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, কিরে জয়, এই সব কি! 

জয় বলল, কিছু না তো মা, টিভি দেখছি। চশমা ছাড়া তো কিছুই দেখি না। এটা লাগিয়ে কি বড় আর পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। 
আমি হাহাকার করে বললাম, জয়, তোর চোখ এত খারাপ!
ও হাসতে হাসতে বলল, আহ মা, এমন করে বলছ, যেন আমি অন্ধ হয়ে গেছি? 
কেমন দাঁত বের করে হাসছিল, ইচ্ছা করছিল ঠাস করে একটা চটকনা লাগাই। ওমা কি কান্ড, ওর চোখ যে এত খারাপ এটা বলে দিলাম বুঝি! বৌমা, আমি কিন্তু কিছু বলিনি।

শাশুড়ি হাসি গোপন করে আবার বলেছিলেন, ওর আরও কান্ড-কীর্তি শুনবে? বাসায় ও হঠাৎ করেই টুপি লাগানো শুরু করল। আমি স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললাম, যাক এতদিনে ছেলেটার ধর্ম-কর্মে মতি হলো। ওমা, কিসের কি! টুপি লাগিয়ে দিব্যি খাচ্ছে-দাচ্ছে! সন্দেহ হলো, নাহ, গন্ডগোল আছে। জিজ্ঞেস করতেই নিরীহ গলায় বলল, মা, চুল বসাচ্ছি। 
আমার তো মাথায় হাত, চুল বসাচ্ছিস মানে? বান্দরটা বলল কি জানো? বলে, দেখো না, চুল কি শক্ত! জানো মা, মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়, ইচ্ছা করে মাথা কামিয়ে বাথরুম পরিষ্কার করার ব্রাশ বানিয়ে ফেলি। আর দেখো, কেমন ভাঁজ খেয়ে পদ্মার ঢেউ খেলে থাকে। চুল ঠিক করতে দশ-পনেরো মিনিট সময় লাগে। এর কোন মানে হয় বলো, সুপারসনিক যুগে? এ অপচয়, জঘন্য-জঘন্য।
ইভা শাশুড়ীর কথা শুনে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছিল না। এর দেখি অদ্ভুত সব কান্ড কারখানা। ডায়েরিতে এক জায়গায় লিখে রেখেছে সংসদ বাঙ্গালা অভিধান মতে, কুত্তা মানে কুকুর। বন্ধনীতে উল্লেখ করা হয়েছে খেঁকি কুত্তা, ডালকুত্তা, নেড়ি কুত্তা। এই তিন কুত্তাকে কি করে চেনা যাবে এটা বলা হয় নাই। এটা অনুচিত হয়েছে। এদের চেনার উপায় সম্ভবত এরকম,
খেঁকিকুত্তা: দু-পেয়েরা ওর মত নয় দেখে অযথাই খেঁক খেঁক করে।
ডাল কুত্তা: ভার্সিটির ডাল খেতেও যাদের অনীহা নেই।
নেড়িকুত্তা: নেড়া মাথায় বিমর্ষ মুখে যে কুত্তা ঘুরে বেড়ায়।
জয় আরেক জায়গায় লিখেছে, এবারের কোবানী অ্যান্ড চাবানী ঈদে (যে সময় গরু ছাগল কুপিয়ে আরামসে চাবানো হয়) সুবিধে করা গেল না।


ইভা ব্যবহারে একটা কাপড় দিয়ে যতটুকু পারা যায় কম নাড়িয়ে ধুলো সরাতে লাগল। মাগো, কী নোংরা! এত নোংরা মানুষ থাকে, ছি! আর এই সব কি, যেখানে-সেখানে সিগারেটের ছাই ফেলেছে। কোথায় ফেলেনি? অডিও ক্যাসেটের খালি খাপ, পেনস্ট্যান্ড, ডেস্ক ক্যালেন্ডার-এ।
জয় ভেতরে ঢুকে খক খক করে কাশতে কাশতে বলল, ‘একি অবস্থা, ঘর দেখি ধুলায় অন্ধকার, হচ্ছে কী!’
‘দয়া করে একটাই কাজ করো; হয় কাশো, নয়তো কথা বলো।’
‘অ, এই ব্যাপার। জোরে শ্বাস নিতে গিয়ে নাকেমুখে ধুলা ঢুকে গেছে। কিন্তু তুমি করছ কি?’
‘দেখছ না, এত নোংরায় মানুষ থাকে!’
জয় ঠোঁট উল্টে বলল, ‘পরিষ্কার করে লাভ কি, আবার তো নোংরা হবে।’
ইভার খুব রাগ হচ্ছে, ‘লজ্জা করছে না তোমার এসব বলতে?’
‘কি মুশকিল, সত্য বলতে পারব না?’
কর্কশ শব্দে টেলিফোন বাজছে। ইভা বলল, ‘জয়, আমার মাথায় রাগ চেপে যাচ্ছে। তুমি যাও টেলিফোন ধরো।’
জয় টেলিফোনের রিসিভার উঠিয়ে বলল, ‘ইভা, তোমার ফোন।’
‘কে।’
'তোমার বোন ধ্রুবা। কোন সমস্যা হয়েছে কি না বুঝতে পারছি না, আমার সঙ্গে একটা কথাও বলল না।’


ইভার বুক ভয়ে কাঁপতে লাগল। কোন দুঃসংবাদ না তো? বাবার কি কিছু হলো? কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘ধ্রুবা-ধ্রুবা, কি হয়েছে?’
ওপাশ থেকে ফোঁপানোর শব্দ ভেসে এল। ইভার সহ্যাতীত মনে হচ্ছে। ‘ধ্রুবা বল, বল কি হয়েছে; বাবা ঠিক আছে তো?’
ধ্রুবা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আপু, বাবা না আমাকে চড় দিয়েছে।’
ইভার বুক থেকে পাষাণ ভার নেমে গেল। কিন্তু বাবা তো আজতক কারও গায়ে হাত তোলেননি!
‘তুই কি করেছিলি?
‘সাকলে আমি, বাবা-মা নাস্তা করছি। একটা রুটি শেষ করে আরেকটা নিয়েছি মাত্র-’
‘আহ ধ্রুবা, হয়েছে কি সেটা বলবি তো!’
‘আপু, এমন করছ কেন, বলছি তো। বাবা আমাকে বলল, ধ্রুবা এরকম চপচপ করে খাচ্ছিস কেন। আমি বললাম, চপচপ করে খাচ্ছি না তো। বাবা বললেন, ফাজিল মেয়ে চড় খাবি। আমি বললাম, চড় দিতে ইচ্ছা করলে দিয়ে ফেলো। বকছ কেন। বাবা আমাকে ঘুরিয়ে চড় দিলেন। আপু, আপু, বাবা আমাকে চড় দিলেন।’
ধ্রুবা গলা ফাটিয়ে কাঁদতে থাকল। ইভার কেন জানি হাসি পাচ্ছে। ধ্রুবা, বাবা এসব কি শুরু করছে। হাসি চেপে বলল, ‘তো এখন হয়েছে কি?’
‘হয়েছে কি মানে, বিনা কারণে চড় দিলেন, এটা কিছু না!’
‘তুই বললি চড় দিতে, বাবা দিলেন। ব্যস শেষ হয়ে গেল। ’
‘তুমি খুব মজা পাচ্ছ, না?’
‘দূর পাগল, ঠাট্টা করছিলাম।’
ধ্রুবা সম্ভবত টেলিফোন আছড়ে ফেলল।


জয় বলল, ‘কাজটা কিন্তু তুমি ঠিক করলে না।’
‘কি ঠিক করলাম না?’
‘ধ্রুবার সঙ্গে এভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি। টিন-এজ মেয়েরা সাঙ্ঘাতিক আবেগপ্রবণ হয়, উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেললে মহা সমস্যা।’
ইভা অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তুমি মনে হয় টিন-এজ মেয়ে বিশারদ।’
‘ধ্যাৎ, বিয়ের আগে কোন মেয়ের সঙ্গে ভাল করে পরিচয়ই হয়নি। দেখছ তো বাঁশগাছের মতে এই আকৃতি, মেয়েদের সঙ্গে কথা বললেই সব কেমন এলোমেলো হয়ে যেত। ভাল লাগার কথা সাহস করে কাউকে বলতেই পারলাম না। বাঁশগাছ দেখে মেয়েরাও গা করল না। একজনের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে, সে হচ্ছ তুমি।’
‘এ নিয়ে খুব কষ্টে আছ মনে হয়, ঘটা করে ঠান্ডা শ্বাস ফেলছ।’
জয় খসখস করে গাল চুলকে হাসল। ইভা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ‘কোনও মেয়েকে তোমার ভাল লাগেনি বলতে চাও?’
‘লাগবে না কেন, লেগেছে। তাতে কি হয়।’
‘কি হয়, সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখে মাথা ঘুরে যায়। তখন আমার মত মেয়েদের কুৎসিত মনে হয়।’
‘যাহ‌, তুমি কুৎসিত কে বলল!’
‘বলতে হবে, আমি বুঝি না, কচি খুকি?
‘বাদ দাও তো এসব।’
‘কেন, বাদ দেব কেন?’
‘আঃ ইভা, কিসব বলছ। আমি শুধু বলেছি ধ্রুবার বয়স কম, ঠিক এ মুহূর্তে ওর সঙ্গে রসিকতাটা করা ঠিক হয়নি। ব্যাস, এই তো।’
‘আমার বোনের সঙ্গে কি করব এটা তোমায় বলে দিতে হবে না।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। খাবার নিয়ে মা বসে আছেন। এসো, খেয়ে নাও।’
‘সব নোংরা হয়েছে। যাও, কাপড় পাল্টে আসছি।’
জয়ের বেরুতে একটু দেরি হলো দেখে ইভা রাগী গলায় বলল, ‘দাঁড়িয়ে আছ যে, আমি কি তোমার সামনে কাপড় পাল্টাব?’

জয় দ্রুত বেরিয়ে যেতে গিয়ে যে ভঙ্গিটা করল পেছন ফিরলে দেখতে পেত ইভা হাসি চাপার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

সহায়ক লিংক: 
কনক পুরুষ, ৩: http://www.ali-mahmed.com/2010/07/blog-post_26.html

Monday, July 26, 2010

কনক পুরুষ: ৩

ইভার খুব অস্থির লাগছে। জয় বলে গেল কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটায় চলে আসবে। এখান থেকে ওরা বাবার ওখানে যাবে। ওর গোল সোনালী হাতঘড়িটায় এখন বাজছে পাঁচটা বিশ। এখনও এর পাত্তা নেই। না এলে শুধু শুধু বলা কেন! অপেক্ষা করা যন্ত্রণার একশেষ। ওর শাশুড়ী মুখ কালো করে বলে গেছেন, ‘ওর আজ-ই দেরি করার ছিল। তুমি দেখো, বৌমা, ও এলে তোমার সামনে ঠাস করে চড় দেব। ওমা, তুমি হাসছ, বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি, দাঁড়াও, আসুক। তুমি কিন্তু ও আসার সঙ্গে সঙ্গে আমায় খবর দেবে।’
ইভা হাসি চেপে বলল, ‘সঙ্গে সঙ্গে খবর দিতে হবে কেন, মা!’
‘কি বলছ, দেরি হলে রাগ পড়ে যাবে না?’

এই মহিলার চেহারায় তেমন কোন বিশেষত্ব নেই, কিন্তু ইভা অসম্ভব পছন্দ করে ফেলেছে। ওর চোখ ভিজে এলো নিজের মা’র কথা মনে করে। ইভা ক্ষীণ গলায় বলল, ‘মা, আজ রাতটা বাবার ওখানে থাকলে আপনি কি রাগ করবেন?’
‘ওমা, আমি রাগ করব কি, পাগল মেয়ে। জয়ও থেকে যাক না আজ তোমাদের ওখানে।’ 

ইভার গাল টাল লাল রঙে ভেসে গেল। পালিয়ে ছাদে চলে এল। এদের ছাদটা খুব সুন্দর। চারদিক টব দিয়ে ভরে ফেলেছে। ফুলের গাছ, অর্কিড, ক্যাকটাসের কমতি নেই কিন্তু সর্বত্র অযত্নের ছাপ। কয়েকটা টবের মাটি শুকিয়ে সাদা হয়ে আছে! কিছু গাছের পাতা বিবর্ণ। ইভা একটা বালতি এনে ঘুরে ঘুরে পানি দিতে লাগল। বিবর্ণ পাতাগুলো ফেলে দিল।
শাশুড়ী শুকিয়ে যাওয়া কাপড় উঠিয়ে নেয়ার জন্যে এসে সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন, ‘করেছ কি, বৌমা!’
‘কি, মা?’
‘এই যে, পানি দিলে!’

‘শুকিয়ে ছিল যে-।
‘রাগারাগি করে ও তোমার মন খারাপ করে দেবে।’
‘রাগ করবে কেন, মা?’
‘আরে, বলো না। আমি একদিন এ অবস্থা দেখে পানি দিলাম। ওর দশ-বারোটা গাছ মরে গেল। মরল কেন, আল্লা জানে! ওর কি লাফালাফি। জানো, আমার কেমন ভয় হচ্ছিল। আমি হাসতে হাসতে বললাম, হয়েছে কি, তুই এরকম করছিস কেন?
ও বলল, তুমি আমার এতগুলো গাছ মেরে ফেললে, আবার হাসছ। সত্যি করে বলো দেখি একটুও খারাপ লাগছে না?
কাঁটাঅলা কয়েকটা গাছ মরে গেছে। হয়েছে কি, এসব তো আবর্জনা। কি কাজে লাগে বল। চামার শ্রেণীর গাছ সব।
তোমার তাহলে ধারণা এগুলো চামার শ্রেণীর গাছ!
তুই-ই বল, কি কাজে লাগে। না ফুল, না ফল।
জয় ঝড়ের বেগে চলে গেল। আমি কত বললাম আরে রাগ করছিস, ঠাট্টা করলাম। কে শোনে কার কথা। ওদিন রাতে ও রাগ করে ভাত খেলো না।’
শাশুড়ী এক নি:শ্বাসে কথাগুলো বলে থামলে ইভা বলল, ‘মা, ওগুলো তো ক্যাকটাস। খুব অল্প পানি দিতে হয়। বেশি দিলে মরে যায়।’
ইভার শাশুড়ী কাপড় নিয়ে নেমে যেতে যেতে বললেন, ‘ক্যাকটাস না হয়ে করলা হলে অন্তত ভাজি করে খাওয়া যেত।’


ইভা চেয়ার এনে চুপচাপ বসে সূর্যাস্ত দেখতে লাগল। আলো হঠিয়ে অন্ধকার গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। বুকে কেমন চাপা কষ্ট হচ্ছে। কী কুৎসিত বিষণ্নতা! প্রকৃতি তার সন্তানের ওপর কি প্রভাবই না ফেলে। পেছন থেতে জয় উঁচু গলায় বলল, ‘এই-এই, অন্ধকারে বসে আছ যে, ঠান্ডা লাগছে না? শরীর খারাপ করবে তো।’
ইভার হিম-হিম গলা,
করলে করবে।’
‘কি মুশকিল, জ্বর-টর হলে!’
‘জ্বর হলে তোমার কোন অসুবিধা হবে?’
‘ঘটনা কী! তুমি মনে হয় কোন কারণে আমার উপর রেগে আছ। কারণটা ধরতে পারছি না।’
‘ধরতে পারছ না?’
‘না। অ-আচ্ছা, মনে পড়েছে; পাঁচটায় আসার কথা ছিল।’
‘পাঁচটা তো বাজেনি এখনও, না?’
‘সরি, তন্ময়ের ওখানে দেরি হলো।’
ইভার গলার স্বর নিজের অজান্তেই কোমল হলো, ‘তন্ময় ভাইকে বলেছিলে আমি দেখা করতে বলেছি?’
‘হুঁ।’
‘কি বললেন?’
‘বলল তো কাল আসবে। আসে কি না জানে। এসব কথা থাক, এ নিয়ে আমার মন এমনিতেই খারাপ।’
ইভা কথা ঘুরাবার জন্যে বলল, ‘ওহ, ভুলে গেছি, তোমার কি মা’র সঙ্গে দেখা হয়েছে?’
‘উঁহু, কেন? ’
‘মা বলেছিলেন তুমি আসার সঙ্গে সঙ্গে যেন খবর দিই। দেরি করেছ বলে তোমাকে ঠাস করে চড় দেবেন। জানাতে দেরি হলে ওনার নাকি রাগ কমে যাবে। তোমার মা’র রাগী মুখ দেখে কিন্তু মনেই হয় না ওঁর মনটা এত কোমল।’
জয় আনমনা হয়ে বলল, ‘জানো, ইভা, আমি যখন খুব ছোট, মা খুব রেগে গেলে লুকিয়ে অপেক্ষা করতাম মা কখন পান খাবেন। পান মুখে দিলে মা’র রুক্ষ কালো মুখটা কেমন কমনীয় হয়ে উঠত।’
ইভা তির্যক গলায় বলর, ‘তোমার মুখটাও তো কম গম্ভীর না, পান খেয়ে দেখতো পারো।’

‘পান খাওয়া লাল-লাল দাঁত তোমার অপছন্দ হবে না বলছ?’
‘তোমাকে পছন্দ-অপছন্দ করতে আমার বয়েই গেছে।’


জয় আহত চোখে তাকিয়ে রইল। চশমার কাঁচ কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার বলে খুব একটা হেরফের হলো না। তবু ইভা না দেখে ফেলে ভেবে মুখ ঘুরিয়ে নিল। তার প্রয়োজন ছিল না। অন্ধকারকে কুৎসিত বলে যত গালাগাল করা হোক, এসব গায়ে না মেখে মানুষের লজ্জা তার মমতার চাদর দিয়ে ঢেকে রাখে।
ইভার কি করে টের পেল কে জানে! নিঃসঙ্কোচে হাত ধরে বলল, ‘অ্যাই, কথা বলছ না যে, কি হয়েছে?’
জয় কঠিন হাতে ইভার হাত সরিয়ে পা বাড়াল। ইভা পেছন থেকে দু’হাতে ধরে ফেলল, খেয়াল নেই ওর বুক জয়ের কর্কশ পিঠ ছুঁয়ে আছে। জয়ও খুব রেগে ছিল বলেই ব্যাপারটা বুঝতে যথেষ্ট সময় লাগল। কয়েকবার ছাড়ানোর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। কেমন অন্য রকম এক অনুভূতি। শরীরের সমস্ত রক্ত কি মস্তিষ্কে গিয়ে জমা হচ্ছে? নিজের হৃদপিন্ডের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।
জয় দুর্বল গলায় বলল, ‘ছাড়ো, ছাড়ো।’
‘উঁহু, বলো রাগ করোনি?’
জয় কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘কে যেন উপরে আসছে।’
‘আসুক। কি ছেলেমানুষ তুমি, ঠাট্টা করলাম আর তুমি কিনা- না, আগে বলো আমার  ওপর তোমার রাগ নেই।’
জয়ের একবার রাগ হলে কমতে সময় লাগে, চট করে নামে না। এখনও যথেষ্ট রাগ আছে। এ মুহুর্তে পরিত্রাণের উপায় নেই দেখে মুখে বলল,
না নেই।

ইভা জয়কে ছেড়ে দিয়ে হাসি চাপল। লম্বা লম্বা পা ফেলে এ যেভাবে নিচে নামছে, উল্টে পড়বে না তো আবার? জয় হনহন করে নিজের রুমে যাচ্ছিল। মা পথ আগলে বললেন, ‘তোর চোখ-মুখ লাল কেন রে, জ্বর-টর নাকি?’
জয় থমথমে গলায় বলল, ‘না।’
‘না কি রে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে একশো দুই ডিগ্রী জ্বর।’
‘একশো দুই ডিগ্রী জ্বর, তুমি কি থার্মোমিটার?’
ইভা নিরীহ মুখে বলল, ‘মা, থার্মোমিটার নিয়ে আসব?’
মা বললেন, ‘আমার কথা বিশ্বাস না হলে থার্মোমিটার লাগিয়ে দেখ, পরীক্ষা হয়ে যাক।’
জয় মুখ আরও অন্ধকার করে বলল, ‘পরীক্ষার প্রয়োজন নাই।’
‘দেখলে তো অসুবিধা নাই। যাও তো, বৌমা, থার্মোমিটার নিয়ে আসো।’

জয় হুঙ্কার দিল, ‘মা, আমি কিন্তু ওটা মট্‌ করে দু’টুকরা করে ফেলব।’
‘বুঝেছি, জ্বর তোর মাথায় উঠে গেছে। আয় তোর মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালি। জানো, বৌমা, এই এটটুকুন যখন ছিল, ওর খুব জ্বর হলো। কি যে ভয় করছিল। তখন ওর সমস্ত কাপড় খুলে শরীরে স্পন্জ-’
জয় চেঁচিয়ে বলল, ‘মা-মা, তুমি বাইরের লোকের সামনে আমার সম্বন্ধে যা তা বলো, এর মানে কি! পাইছটা কী!
জয়ের মা হাসি চাপলেন, ‘এ বাইরের লোক!’

জয় এর উত্তর না দিয়ে রুমে ঢুকে দরজা আছড়ে মারল। ভেতর থেকে ধুপধাপ শব্দ ভেসে আসছে। কি যেন একটা ফেলে দেয়ায় ঝনঝন শব্দ হচ্ছে।
জয়ের মা বিরক্ত গলায় বললেন, ‘এই হলো আমার ছেলে।’
ইভা অল্প সময়ে অনেক কিছুই দেখল। শাশুড়ীর গলা শুনে বিভ্রান্ত হওয়ার অবকাশ নেই। এই মহিলার চোখে ঝরে পড়ছে ছেলের জন্যে পৃথিবীর সমস্ত মমতা। কী অসম্ভব সুন্দর একটা দৃশ্য!


জয়ের রাগ কমা দূরে থাক উত্তরোত্তর বাড়ছে। ও দেখতে ভাল না এটা যে জানে না এমন না, জানে। ও বাঁশগাছ, চশমা ছাড়া কিছুই দেখে না, ভাল করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না, মানুষকে আকর্ষণ করার মত কোন গুণ ওর মাঝে নেই। এতে ওর কি হাত? আর ইভা এসবই দেখল! মুখের ওপর দুম করে বলে দিল, তোমাকে পছন্দ-অপছন্দ করতে দায় পড়ে নেই, কিছুই যায় আসে না!
ইভা পরীর মত সুন্দর বলেই কি এভাবে বলতে পারল? ওর সঙ্গে বিয়ে হয়ে মনে হয় খুব যন্ত্রণায় আছে। এতই যখন অপছন্দ ওকে বিয়ে না করলেই হত। ও তো আর বলেনি বাঁশগাছ বিয়ে করো, নইলে ত্রিশতলা থেকে ঝাঁপ দেব। সিগারেট ধরিয়ে এক দু’টা টান দিয়েই নিভিয়ে ফেলল। নিভিয়েই ক্ষান্ত হলো না দুমড়ে-মুচড়ে পিষে ফেলল। এটাও পছন্দ হলো না। উঠিয়ে কুটি কুটি করে ফেলল।
খুঁজে রকওয়েলের ‘নাইফ’ বের করল। এটা ওর প্রিয় গান। প্রত্যেকবার শোনার সময় নতুন মনে হয়। মনটা অন্য রকম হয়ে যায়।


আড়চোখে ইভাকে ঢুকতে দেখে চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইল। ইভা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খাটের মাঝখানে বসে পা দোলাতে লাগল। আশ্চর্য কী নির্বিকার ভঙ্গিতেই না পা নাচাচ্ছে! জয় অবাক হয়ে ভাবল, পাশের কেউ পা নাড়ালে ও অসম্ভব বিরক্ত হয়। চড় দিতে ইচ্ছা করে। এখন তো মোটেও খারাপ লাগছে না, সমস্যাটা কি! কেমন টুং টুং শব্দ হচ্ছে। মুখ নিচু করে রেখেছিল বলেই উৎসটা ধরতে পারছে না। মুখ তুললে আবার মান থাকে না। মাথা যথাসম্ভব না নাড়িয়ে লুকিয়ে দেখল ইভার ফর্সা দু’হাতে টকটকে লাল কাঁচের চুড়ি। অবাক কান্ড, চুড়ি কখন পরল!
ইভা পা নাচানোর বেগ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এসব সাজ-পোশাক তাহলে খুলে ফেলি?

জয় চোখ তুলে থমথমে মুখে বলল, ‘আমাকে বলছ কেন?’
আরে এ দেখি সাজগোজ করে আছে, কি চমৎকারই না দেখাচ্ছে! তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে দেখে কেমন লজ্জা-লজ্জা লাগছে।
ইভা বলল, ‘বললে না বাবারও ওখানে নিয়ে যাবে। আমিও কি বোকা, সত্যি ভেবে সেই কখন থেকে কাপড় বসে আছি।’
‘তোমার ভাবভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে না। ’
জয় ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমার ভাবভঙ্গি নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর প্রয়োজন দেখি না। বেশ বুঝতে পারছি আমাকে বিয়ে করে নরক যন্ত্রণা ভোগ করছ।’
ইভা হাসি চাপল। এ মুহুর্তে হেসে ফেললে অনর্থ হয়ে যাবে। কেমন গাল ফুলিয়ে বসে আছে, অবিকল শিশুর মত দেখাচ্ছে। ইভা অনেক কথাই বলতে চেয়েছিল কিছুই বলতে পারল না।
বেরুবার সময় ইতস্তত করে বলল, ‘তুমি কি এ-ই পরে যাবে? ’
‘এই, এই মানে কি?’
‘বলছিলাম, কাপড় পাল্টে নিলে ভাল হতো না।’
‘কেন, স্যুট টাই পরে যেতে হবে? এসব পরে গেলে তোমার খুব অসুবিধা হবে, মান থাকবে না। আমাকে আরও খারাপ দেখাবে, এই তো?’
‘না বলছিলাম-।’
জয় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আমার যা খুশি তাই পরে যাব। ইচ্ছে হলে হাফপ্যান্ট পরব। চিকন চিকন ঠ্যাং বেরিয়ে থাকবে, থাকুক, হু’জ কেয়ার।’


স্কুটার ঝড়ের গতিতে এগুচ্ছে। ইভার মন ভার হয়ে আছে। এ একহাত দূরে কেমন জড়সড় হয়ে বসে আছে ও। পুরো ম্যাচ শেষ করে বাতাস বাঁচিয়ে সিগারেট ধরাল। ইভা মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই আস্ত সিগারেটটা ফেলে দিল। ও এটা কেন করল কে জানে? সিগারেটের ধোঁয়ায় ওর কষ্ট হবে ভেবে? ইভা চোখে জল নিয়ে ভাবল মানুষটা পাগলাটে হলেও এর মনটা নরোম। অন্যকিছু ভাবার চেষ্টা করল, সোডিয়াম লাইটের জঘন্য আলোয় দেখল, ড্রাইভারের পেছনের বোর্ডে লেখা: 
"আজনবি পরিবহন।
চালোক নন্নু মিঞা।
শারি ওড়না
সাবদান।"

নান্নু মিঞা কেবল এটুকু লিখেই ক্ষান্ত হয়নি। সাবধান এর নিচে দু’টা হাড়, একটা খুলি এঁকে দিয়েছে। হাড় না কি এটা অবশ্য আন্দাজ করে নিতে হয়। কেমন লাউয়ের মত দেখাচ্ছে!
ইভার বুক থেকে পাষাণ ভার নেমে গেল। স্কুটার থেকে নামার সময় ঝলমলে মুখে বলল, ‘আবার দেখা হবে, নান্নু ভাই।’
লোকটা বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে রইল, তাজ্জবের কথা, আফায় নাম জানল কেমনে!


*কনক পুরুষ: http://tinyurl.com/29uf4sq

Tuesday, October 13, 2009

কাজীদা: একজন লেখক বানাবার মেশিন!


চিঠিটা ছাপিয়ে ঠিক করলাম কিনা কে জানে? যেহেতু চিঠিটা কাজীদা প্রতিষ্ঠানের প্যাডে লিখেছেন; এটাকে অন্তত ব্যক্তিগত চিঠি বলা চলে না, এটাই ভরসা। আমার কেবল মনে হচ্ছে, কাজীদা নামের এই লেখক বানাবার মেশিনটার সমস্ত খুঁটিনাটি এই প্রজন্মের না-জানাটা অন্যায়। এই মানুষটার অসাধারণ গুণ হচ্ছে, তিনি প্রত্যেকটা পান্ডুলিপি খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পড়েন, প্রতিটা অক্ষর! এবং বানানের ব্যপারে অতি সাবধানী একজন মানুষ। একসময় আমি কাউকে বলতাম, অভিধান না-দেখে প্রজাপতি-সেবার কোন বই দেখে মিলিয়ে নিন।

বাংলা একাডেমীর কথা শুনলে আমরা বিনম্র শ্রদ্ধায় হাঁ করে থাকি,
গা কাঁপে। আহা, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক যখন বলেন, শেখ হাসিনা একজন বিশিষ্ট লেখক হিসাবে বই-মেলা উদ্বোধন করছেন; তখনও গা কাঁপে, অন্য কারণে। তখন আমরা গা দুলিয়ে হাসি, নইলে হাসিটা ঠিক জমে না।
বাংলা একাডেমী থেকে ৯৩ সালে আমার যে উপন্যাস ছাপা হয়েছিল ওটায় যে-কেউ খুঁজলে শতেক বানানের ভুল বের করতে পারবেন, আমি নিশ্চিত। হা ঈশ্বর, বাংলা একাডেমীর কি প্রুফ-রীডার বলতে কারও অস্তিত্ব নাই?
ভদ্রলোকের নাম বলে লজ্জা দিতে চাচ্ছি না। লেখালেখি ভুবনের একজন তুখোড় মানুষ, বাংলা একাডেমীর পরিচালককে 'কনক পুরুষ' উপন্যাসের সৌজন্য কপি দিলে; তিনি এটার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন যেন এটা একটা শুয়োঁপোকা! নিতে না পারলে বেঁচে যান এমন। এই বেট, আমি চলে আসার পর এটা তিনি ট্রাশ-ক্যানে ফেলে দিয়েছিলেন।

এ বড়ো বিচিত্র, আমাদের দেশের যারা সাহিত্য কপকপ করে চিবিয়ে খান, অন্য প্রকাশী হলে সমস্যা নাই কিন্তু এঁদের প্রজাপতি-সেবা প্রকাশনীর প্রতি আছে সীমাহীন তাচ্ছিল্য। অথচ এ দেশের অধিকাংশ প্রকাশনীর প্রকাশক মহোদয়গণ কাজী আনোয়ার হোসেনের নখের যোগ্য বলে আমি মনে করি না। কসম, একজন প্রকাশক আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কোন বাংলা একাডেমী? ভাবতে আমার গা গুলায়, এরাই নির্ধারণ করে দেন কে লেখক, কে লেখক নন!

ফাঁকতালে কাজীদাকে দেখে, আমাদের পাছাভারী প্রকাশক-সম্পাদক মহোদয়গণ যদি খানিকটা শেখার চেষ্টা করার তকলীফ-ক্লেশ স্বীকার করতেন, তাহলে বেশ হতো! আফসোস, এদের শেখা শেষ, মাদ্রাসা-পাশ হুজুরদের যেমন শেখার কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, তেমনি।

কনক পুরুষ উপন্যাসটা লিখেছিলাম খুব তাড়াহুড়া করে, ঝড়ের গতিতে। লেখা হয়েছিল সম্ভবত একরাতে। শেখ আবদুল হাকিমের উপর বিরক্ত হয়ে, ডাকে এটা কাজীদাকে পাঠালে তিনি এই চিঠিটা লিখে দেখা করতে বলেছিলেন। চিঠি পড়ে আমার কান-টান লাল! ইশরে, এটা পাঠাবার আগে পান্ডুলিপিটা খানিকটা যত্ম নিয়ে দেখে দিলাম না কেন? অবশ্য চেষ্টা করলেও বানান ভুল নিয়ে খুব বেশি কিছু করতে পারতাম না। আমার মধ্যে বড় ধরনের সমস্যা আছে! বানান এখনও আমাকে বড় ভোগায়- যে শব্দ অজস্রবার লিখেছি এটা নিয়ে এখনও কস্তাকস্তি করতে হয়। হ্রস্ব-ই কার নাকি দীর্ঘ-ই কার? দরজা, জরদা গুলিয়ে ফেলি, টপটেন নাকি টেনটপ ইত্যাদি।


কাজীদার কথা লিখেছিলাম, আমার দেখা একজন চমৎকার মানুষ- লেখক বানাবার কারিগর! তিনি আমার বই ছাপিয়েছেন বলেই তাঁর প্রতি মুগ্ধতা চুঁইয়ে পড়ে এমনটা না। তাঁর কিছু বিষয় আমার মোটেও পছন্দ না, এই প্রকাশনীর প্রচ্ছদগুলো বড়ো খেলো, যা-তা!
আরেকটা বিষয়,
তিনি লেখক হিসাবে টিংকু ওরফে কাজী শাহনুরকে সবাইকে ছাপিয়ে বড়ো বেশি সামনে নিয়ে এসেছিলেন। এই সিদ্ধান্তটা আমার কাছে বড়ো ধরনের ভুল মনে হয়, তিনি পরিবারতন্ত্রের খোলস থেকে বের হতে পারেননি- অনেক দুঁদে লেখক ছিটকে পড়লেন। এঁদের মধ্যে আমার নিজের কথা বলার স্পর্ধা দেখাচ্ছি না। আমার সঙ্গে সমস্যাটা ভিন্ন! ক্রমশ তার প্রকাশনীর দবদবা কমে এলো। যাগগে, কে কিভাবে তাঁর প্রতিষ্ঠান চালাবেন এটা তাঁর এখতিয়ার কিন্তু কষ্ট হয়!

যাগ গে, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।
বই নিয়ে কিছু কথাবার্তা হলো। কাজীদার আগ্রহ নিউজপ্রিন্টে ছাপানো। ছাপার হিসাবটা সম্ভবত এমন; প্রজাপতি-হোয়াইট প্রিন্টে ছাপা হয় ১২০০, সেবা-নিউজপ্রিন্টে ৩৩০০। সেবা-নিউজপ্রিন্টের পাঠক বেশি, রয়্যালটির টাকাও বেশি তবুও নিউজপ্রিন্টে ছাপার বিষয়ে আমি রাজি হলাম না।
তিনি চাচ্ছিলেন লেখাটায় কিছু পরিবর্তন আনতে। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে,
লেখাটায় পরিবর্তন, যোগ-বিয়োগ করার কিছু নাই এটাও বললাম। আমি কাজীদার কাছে ভারী কৃতজ্ঞ তিনি আমার মত অতি অখ্যাত একজন কলমবাজের আবদার মেনে নিয়েছিলেন। আজীবন তাঁর এই সহৃদয়তার কথা ভুলব না।
তিনি মূল লেখাটার (কনক পুরুষ) কোন পরিবর্তন করেননি। কেবল অসংখ্য ভুলভাল বানান, বাক্যরীতি সংশোধন করে দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য 'রূপবান মার্কা' প্রচ্ছদটা দেখে মন অনেকখানি বিষণ্ন হয়েছিল কিন্তু এটার ব্যাপারে আমার কোন হাত ছিল না!

'ইভার মা'-র যে অংশটুকু, 'তন্ময়'-এর অতি সংক্ষিপ্ত পরিণতি নিয়ে কাজীদার আপত্তি ছিল: কনক পুরুষের কিছু জায়গায় জামাল সাহেব নামের মানুষটার তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে মোটা দাগের কিছু রসিকতা ছিল।
এই বিষয়টা আমরা অনেক শিক্ষিত মানুষরা অহরহ করি। অবলীলায় কারও শরীরের ক্রটি নিয়ে রসিকতা, এ অন্যায়, কুৎসিত অন্যায়। এ অন্যায়ে আমি কেন যোগ দিলাম, উপন্যাসে কেন তুলে আনলাম? আমি যে কথাটা প্রায়শ বলি, একেকজন পাঠককে আমি মনে করি একেকটা চলমান ক্ষুর- তাঁদের বিবেচনা বোধের উপর আমার শ্রদ্ধা অপরিসীম। হাস যেমন ঘোলা পানি থেকে পরিষ্কার পানিটুকু বের করে নেয় তেমনি তাঁরা তাঁদের সুবুদ্ধি দিয়ে সুভালাভালি-নিরাপদ ভাবনাটা খুঁজে নেন।
আজ আমি যদি আবারও এই লেখাটাই (কনক পুরুষ) লিখতাম, কিচ্ছু পরিবর্তন করতাম না। কেবল এই লাইনটুকু যোগ করতাম: 'ইভার মা-র চোখ জলে ভরে আসে, ইভার বাবা তার পৃথুল দেহ নিয়ে এমন করেন কেন? এতে তার নিজের কী হাত!' ব্যস এইটুকুই।

আর ইভার মাকে নিয়ে খুব বেশি কিছু লেখার আমার আগ্রহ ছিল না কারণ এই ধরনের রোবট টাইপের মানুষদের জীবনে গল্প করার মত গল্প খুব একটা থাকে না। এরা নির্দিষ্ট একটা বৃত্তে অনবরত ঘুরপাক খান- এর বাইরে বেরুবোর কথা ভাবতেই পারেন না।

'তন্ময়' নামের অভাগা চরিত্রটির অতি সংক্ষিপ্ত পরিণতি:
তন্ময়ের এ পৃথিবী থেকে দুম করে সরে না-গিয়ে উপায় ছিল না, আমি ইচ্ছা করলেই তার যাওয়াটা ঠেকাতে পারতাম না। কলম আমাকে টেনে নিয়ে যায়, জিম্মি আমি; একে আটকাবার ক্ষমতার আমার নাই!
তবে এখানে ছোট্ট একটা যোগসূত্র আছে:
যোগসূত্রটা হচ্ছে, তন্ময় নামের একটা শেকড় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পাশাপাশি অন্য একটা শেকড় ঊঁকিঝুকি মারছে।
অর্থাৎ, তন্ময় বিদায় নিচ্ছে, ইভা এবং জয় আরেকটা শেকড় ছড়িয়ে দিচ্ছে: "ইভা কান্না থামিয়ে বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল। ...। এক সময় শরীর তার নিজস্ব ভঙ্গিতে কথা বলা শুরু করল। এ ভাষার উৎস কী, কে জানে! এক সময় জয় ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে ভাবল, আসলে স্বর্গ বলে আলাদা কিছু নেই।" (কনক পুরুষ)

Tuesday, October 6, 2009

কনক পুরুষ: ২

"জামাল সাহেব ব্যালকনিতে রাখা রকিং চেয়ারে অনবরত দোল খাচ্ছেন। এ মুহুর্তে কেউ ভাববে মহা আনন্দে আছেন। কোমন চাপা কষ্ট; ফুসফুসটা খালি মনে হচ্ছে, লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছেন। ইভার শূণ্যতা এমন হবে বুঝতে পারেননি। মেয়ের বিয়ের পর সব বাবারই সম্ভবত খারাপ লাগে, কিন্তু তাই বলে এই বেদনার কোন মানে হয়! মেয়েটা সুখী হবে কি-না কে জানে? জয় ছেলেটাকে ওঁর অন্যরকম মনে হয়েছে, দশজনের চেয়ে আলাদা। ইভার সম্বন্ধে কিছুই গোপন করেননি, যেচে নিজ থেকেই সব বলেছেন। এটা ভুল হলো কি-না কে জানে, ভুল হলে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছেন। ছেলেটার সম্ভবত টাকা-পয়সার কিছু সমস্যা আছে। এটা সমস্যা নয়, ব্যাঙ্ক-এ প্রচুর পড়ে আছে। বছর দু’য়েক হলো ব্যবসা সব গুটিয়ে ফেলেছেন। এ বয়সে দৌড়াদৌড়ি করতে ভাল লাগে না, তাছাড়া হার্টের অবস্থাও খুব একটা সুবিধের নয়।

ব্যবসার কথায় মাবু ভাইয়ের কথা মনে পড়ল। মাঝে মাঝে বলতেন, “মাবু ভাই, আপনি কি মহাপুরুষ?”
মাবু ভাই বলতেন, “ধুর, মহাপুরুষ হতে যাব কোন দু:খে। এদের কষ্টের শেষ নাই- ইচ্ছা হলেই সিঙ্গারা খেতে পারে না, লাফাতে পারে না।”
এ লোকটা তাঁর জন্যে কি না করেছেন! প্রথম জীবনে টাকার জন্যে ব্যবসা করতে পারছিলেন না। স্থাবর কোন সম্পত্তিও ছিল না যে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেবেন। মাবু ভাই তাঁর নিজের জমি বন্ধক রেখে লাখ পাঁচেক টাকা নিয়ে দিলেন, নগদ দিলেন আড়াই লাখ। প্রথম প্রথম কিছু লাভের টাকা দিতে পেরেছিলেন। ক্রমশ ব্যবসা খারাপ হতে থাকলে তিনি ব্যবসার টাকা খেয়ে ফেলতে লাগলেন, উপায় ছিল না। মাবু ভাই জানতেন না এমন নয়, কিন্তু এ নিয়ে একট কথাও বলতেন না। জামাল সাহেবের লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করত। ধর্মকর্মে বিশেষ আস্থা ছিল না। কায়মনে প্রার্থনা করতেন, প্রভু আমাকে দিয়ে ভিক্ষে করাও, টুঁ শব্দ করব না, এ লোকের কাছে জোচ্চর না হতে হয়।
মাবু ভাইকে মাঝে মাঝে দৃঢ় গলায় বলতেন, “আমি যদি মরে যাই কি হবে জানি না, বেঁচে থাকলে বিশ্বাস করুন, নয়-ছয় করব না। আমি জানি আমার মধ্যে ট্যালেন্ট আছে। এ দু:সময় চিরকাল থাকবে না।”
কখনও বা হতাশ হয়ে বলতেন, “মাবু ভাই, আর তো উপায় দেখি না। আসেন, দু’জনে তেত্রিশতলা থেকে ঝাঁপ দিই। পরকালে আমি আপনার চাকর হব।”

পনেরো-ষোলো বছরের বড় এ লোক এরকম বন্ধু হলো কি করে কে জানে! শুধু এই না। আরও যে কত ঋণ তা বলে শেষ করা যাবে না। যখনই ভেঙে পরেড়ছেন দেবদূতের মত পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। দু:সময় কেটে গেছিল ঠিকই। তিনি জানতেন টাকা ফেরত দিলেই এসব ঋণ শেষ না না, হতে পারে না!
কিন্তু ওঁর জন্যে কিছু করলেই মাবু ভাই বিরক্ত হতেন, ”জামাল, ঢের হয়েছে, এবার থামো তো বাপু।”
কে শোনে কার কথা। জামাল সাহেব এসব কথা গায়ে মাখতেন না।

ইভার মা সশব্দে চা’র কাপ নামিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, ‘কী-সব কান্ড তোমার! চুরুটটা নিভে গেছে, এমন ভঙ্গিতে টানছ যেন ভেজা চুলো থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।’
জামাল সাহেব দৃষ্টি থেকে বিষন্নভাব মুছে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেস্টা করে ব্যর্থ হলেন। চা’র কাপ টেনে নিয়ে চুরুটটা ফেলে দিলেন। চায়ের কাপ-এ চুমুক দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ইভার মা, মেয়েটার জন্যে মনটা খুব অশান্ত হয়ে আছে।’
‘বিয়ে হলে মেয়ে পরের ঘরে যাবে, এটা তো নতুন কিছু না।’
‘এত মমতা দিয়ে... এই- এই জন্যে!’
‘এটাই মেয়েদের নিয়তি, বিয়ের পর সব এলোমেলো হয়ে যায়। নতুন করে শুরু হয় সব। মেয়ের বাবা, মা’র, সবার।’
জামাল সাহেব সামলাতে আপ্রাণ চেষ্টা করলেন, টুপ করে একফোঁটা চোখের জল চা’র কাপে পড়ল। স্বস্থির নি:শ্বাস ফেলে ভাবলেন, জোবেদার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।
জোবেদা বললেন, ‘আ:, কি ছেলেমানুষী করছ, ভালোয়-ভালোয় আপদ বিদেয় হয়েছে।’
জামাল সাহেব ঘর কাঁপিয়ে বললেন, ‘তোমার শরীর যেমন পালওয়ানের মত, মনটাও তেমনি।’

এটা জামাল সাহেব প্রায়ই বলেন হাসি হাসি মুখ করে। জোবেদা বেগমের পৃথুল দেহ দেখে তাই মনে হবে। বিয়ের পর পর এমন ছিলেন না, ওসময় মনে হত জোরে বাতাস এলে উল্টে পড়বেন।
জামাল সাহেব প্রায়ই বলতেন, ‘মোটা মেয়েদের কিন্তু আমার একদম পছন্দ না। সাবধান, রোজ তোমাকে উঠিয়ে মাপ নেব, একটু এদিক সেদিক হলেই, হুঁ-হুঁ, খাওয়া বন্ধ।’
ইভার হওয়ার পর হু-হু করে মোটা তকে থাকলেন। ধ্রুবা হওয়ার পর তো হিমালয় পর্বত। এ নিয়ে বাবা মেয়ে মিলে কী হাসাহাসি।

একদিন সবাই মিলে টিভি দেখছে। জামাল সাহেব উঁচু গলায় বললেন, “ইভা, বিটিভির শাড়ির বিজ্ঞাপন গুলো দেখেছিস?”
ইভা মগ্ন হয়ে টিভি দেখছিল। বাধা পেয়ে কপট রাগে বলল,“এই যে, ওল্ড ম্যান, বিরক্ত কোরো না তো। দেখব না কেন, না দেখে উপায় আছে?”
“তোর অন্য কিছু মনে হয়নি?”
“আ:, কি বলবে বলে ফেলো, খামোকা কথা পেঁচিয়ো না।”
“তিন মণের লাশগুলো বিভিন্ন মার্কা শাড়ি পরে কি অহঙ্কারী গলায় বলে, অমুক শাড়ি পরে আমি রূপবতী হইলাম- তমুক পরে রূপসী হইলাম, এইসব। যে যত মোটা সে তত রূপসী।
"কি আর করা, পাবলিক পছন্দ করে!"
“পাবলিক এসব খাচ্ছে, বলিস কি রে! পিলারের মত জিনিসগুলো যখন সোজা টিভি পর্দায় ছুটে আসে আমার তো ভয়ে আত্মারাম শুকিয়ে যায়, এই বুঝি হার্ট পাম্প করা বাদ দিল।”
ইভা বলল, “বাবা, তোমার কথা শেষ হয়েছে?”
“না, ইয়ে মানে ভাবছিলাম। হীরা কয়লায় চাপা পড়ে আছে রে, তোর মা কিন্তু ভাল শাড়ির মডেল হতে পারত। হাত বাঁকিয়ে আঁচল মেলে ঝলমল করে বলত, সবাই বলে আমি নাকি রূপসী, ব্যাপারটা ঘটে ঠিক তখনি যখন ইভার বাবা বলে। হা হা হা।”

আরেকদিনের কথা। ইভা মার পাকা চুল খুঁজে দিচ্ছিল। ইভার বাবা ছোটখাট শরীরটা নিয়ে ঝড়ের বেগে এলেন। হাতে ওই দিনের ইত্তেফাক। নিরীহ মুখে বললেন, “ইভা, এই দেখ সিনেমার একটা বিজ্ঞাপন।”
ইভা বাবার কৌতুকে উপচে পড়া চোখের দিকে তাকিয়ে পত্রিকা নিল। বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে একটা বিশাল দাঁড়িপাল্লা। পাল্লার একদিকে হাবিজাবি অনেক কিছু অন্যদিকে চর্বির ডিপো এক নায়িকা।
ইভা চাপা হেসে বলল, “যাও বাবা তুমি যে কি, কোত্থেকে এসব খুঁজে বের করো!”
“তুই কি বুঝলি সেটা আগে বল।”
“বোঝার কি আছে!”
"তুই দেখি গাধীর গাধী রে। সহজ ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস না। এই দাঁড়িপাল্লার রশিগুলো বেশ মজবুত। কালেভদ্রে শুনিসনি? সিনেমায় তো অহরহ দেখা যায়, একটা চরিত্র আত্মহত্যা করতে গেছে, দড়ি ছিঁড়ে পপাত ধরণীতল- কি যন্ত্রণা বল দেখি। ওদের এই মার্কা দড়ি ব্যবহার করলে নিশ্চিন্তে মৃত্যু হত। আমরা কিন্তু বাজার মত করে ফেলব। আমরা বলব ‘জোবেদা মার্কা’ দড়ি ব্যবহার করুন। তোর মাকে একপাশে বসিয়ে এ দড়ির সহ্যক্ষমতা পরীক্ষা করে বাজারে ছাড়া হবে।"
বাবা-মেয়ে মিলে কী হাসি! জোবেদা বেগম পরে রাগ দেখাতেন ইভার ওপর। চুল ধরে দেয়ালে মাথা ঠুকে দিতেন, একা পেলে।

ইভার মার এ মুহূর্তে রাগ হওয়ার কথা, কিন্তু হাসি পাচ্ছে। হাসি গোপন করলেন, নইলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে। বয়স্ক লোকটা মাঝে-মাঝে কী ছেলেমানুষ হয়ে যায়।
জামাল সাহেব আরেকটা চুরুট ধরিয়ে ঘন ঘন টান দিয়ে নীলচে ধোঁয়ার আড়াল সৃষ্টি করে ফেলেছেন।
ধোঁয়ার আড়াল থেকে বিব্রত গলায় বললেন, ‘ইভার মা, কিছু মনে করো না। ইয়ে, ইভাকে আজ দেখতে যাওয়া যায় না?’
‘কি বলছ! কাল বিয়ে হলো আজ দেখতে যাবে কি!’
‘জাস্ট একটু দেখা করে আসব।’
‘আরে না, ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ভাল চোখে দেখবে না।’
‘জয় মনে হয় না কিছু মনে করবে।’
‘ওদের পরিবারে জামাই ছাড়াও তো অন্যরা রয়েছে।’

জামাল সাহেব গুম হয়ে বসে রইলেন। এ কেমন কথা, নিজের মেয়েকে দেখতে যেতে পারবেন না! বিয়ে হলেই সব অন্যরকম হয়ে যাবে।
ইভার মা বললেন, ‘এসব ভেবে ভেবে তোমার মাথা গরম হচ্ছে। এসো তো নাস্তা করে নাও, ঠান্ডা হচ্ছে।’
নাস্তার টেবিলে বসে জামাল সাহেব খাবার নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। ধ্রুবাকে শুধু শুধু ধমক দিলেন, ‘পশুর মত চপচপ করে খাচ্ছ কেন?’
ধ্রুবা অবাক হয়ে বলল, ‘কই, চপচপ করে খাচ্ছি না তো!’
জামাল সাহেব চেঁচিয়ে বললেন, ‘ইয়েস-ইয়েস, খাচ্ছ।’
ধ্রুবা কাটা-কাটা জবাব দিল, ‘শুধু শুধু বকছ যে!’
‘ফাজিল মেয়ে, তুমি দিন-দিন অভদ্র হচ্ছ, চড় খাবে।’
ধ্রুবা পলকে মা’র দিকে তাকাল। তিনি চোখের ইশারায় মেয়েকে নিষেধ করলেন। মেয়ে সেটা উপেক্ষা করল। শক্ত গলায় বলল, ‘বাবা, তোমার যদি চড় দিতে ইচ্ছা করে দিয়ে ফেলো, এত কথার দরকার কি।’
ধ্রুবার বিষ্ময়ের সীমা রইল না, সত্যি সত্যি বাবা তাকে চড় দিলেন। বাবা চড় দিলেন, চড় দিলেন- এটা ভেবে ওর বুক ফেটে যেতে লাগল। সব কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। উঠে দাঁড়াতে দিয়ে চেয়ার উল্টে ফেলল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে ডাইনিং রুম থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল।

জোবেদা বেগম স্তম্ভিত হলেন। লোকটা এমন করল কেন- এ তো আজ অবধি বাচ্চাদের গায়ে হাত তোলেনি! বন্ধুর মত আচরণ করেছে। অনেকক্ষণ পর ক্ষীণ গলায় বললেন, ‘কাজটা কিন্তু ঠিক করলে না। এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তোলা ঠিক হয়নি।’
‘খুব বড় হয়ে গেছে। পিএইচডি করে ফেলেছে।’
‘একদম ছোট তো আর না, এবার এসএসসি দেবে। কাজটা তুমি ঠিক করলে না।’
‘এক কথা দু’বার বলছ কেন, ঠিক করিনি। বেশ করেছি।’

জামাল সাহেব যে কাজটা কখনও করেন না তাই করলেন, এঁটো প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে পড়লেন। নিজের রুমে আধ শোয়া হয়ে পেপারে চোখ বুলাতে লাগলেন। জোবেদা বেগমের হাত থেকে চা’র কাপ নিয়ে মাথা নিচু করে বললেন, ‘ইভার মা, এ মেয়েটা বড় অভিমানী, এর দিকে একটু খেয়াল রেখো।’
‘খেয়াল রাখব মানে, আমি কি ওর সৎ মা?’
‘না-না, তা না, মানে একটা ব্যাপার-।’
‘কি আবার ব্যাপার, চড় দিলে মেয়ে কি দাঁত বের করে হাসবে?’
‘আঃ, এত ফড় ফড় করো কেন! ওইদিন দেখলাম এক ছেলের সঙ্গে রিকশায়। স্কুল ড্রেস পরা।’
জোবেদা বেগমের গা কাঁপতে লাগল। কী শুনছেন, একি শুনছেন! খাটে ধপ করে বসে তীব্র গলায় বললেন, ‘কি বলছ এসব, কখন দেখেছ?’
‘ওই যে যেদিন আমাদের গাড়ি পাঠাতে দেরি হলো, সেদিন।’

কথাটা বলে জামাল সাহেব একটু সরে বসলেন, জোবেদা হুড়মুড় করে বসাতে বিছানায় রাখা চা’র কাপ উল্টে চাদর মাখামাখি হয়ে গেছে। খাট যে এখনও দাঁড়িয়ে আছে কি মনে করে ভেবে অবাক হলেন।
জোবেদা বেগম গলার তীব্রতা বাড়িয়ে বললেন, ‘এই কথাটা আজ বলছ!’
জামাল সাহেব চুপ করে রইলেন। একে না বললেই ভাল হত, শুধু শুধু যন্ত্রণা করবে। এ এসব ব্যাপারে বড় বেশি সেনসিটিভ।
‘বলো, কি ভেবে আগে বললে না; মেয়ের এত বড় সর্বনাশ তুমি চেয়ে চেয়ে দেখছ! তোমার জন্যেই বড় মেয়েটার আজ এ অবস্থা, জয় যদি জানতে পারে...।’
জামাল সাহেব গলার রগ ফুলিয়ে বললেন, ‘চুপ, ইভা সম্বন্ধে আর একটা কথাও না। মেয়েটাকে তুমি অনেক যন্ত্রণা দিয়েছ। নিষ্পাপ একটা মেয়ে তোমার জন্যেই গত দুইটা বছর কী মানসিক যাতনাই না ভোগ করেছে।’
'শান্ত হও। ইভার প্রতি না-হয় অন্যায় করেছি, তাই বলে ধ্রুবাকে শাসন করব না?’
‘এখন কিছু বলা ঠিক হবে না। সুবিধা করে বলব।’
‘তোমার যত আজগুবী সব কথাবার্তা। মেয়েকে ধরে পিটিয়ে চামড়া খুলে ফেললে একদম সোজা হয়ে যেত।’
‘আমার সামনে থেকে দূর হও।’ ..."

Monday, July 2, 2007

কনক পুরুষ: ১


(আমার ইচ্ছা ছিল চালবাজি করার জন্য। অনেক পুরনো উপন্যাস ছিল এটা। আমার ধারণা ছিল, এটা ধারাবাহিকভাবে পোস্ট করব। আফসোস, ধরা খেয়ে গেলাম। হা ঈশ্বর, এমন মানুষও আছেন। ‘কনক পুরুষ’ উপন্যাসটার কথা এখনও মনে রেখেছেন!
যাই হোক, এই পোস্টটা আমি উৎসর্গ করছি মোসতাকিম রাহী এবং তাঁর মেজদা মোরসালিনকে। কেন?
লেখকরা গল্প বলেন, এই তাঁদের কাজ। আমার মতো অগাবগা লেখকও লেখকদের অনুকরণ করে চেষ্টা করেন গল্প বলতে।
কিন্তু মোসতাকিম রাহী এবং তাঁর মেজদা মোরসালিন গল্প সৃষ্টি করেন, উপাদান যোগান। আমার মতো মানুষকে বিভ্রান্ত, হতবাক করে দেন তাঁদের ভালবাসায়-মমতায়...)।

 ...
"জয় যথাসম্ভব নিঃশব্দে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে, সশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, উফ-ফ, কি ধকলটাই না গেল আজ!
ঘুরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে গেল। মেয়েটা বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে সেই চোখে আছে রাজ্যের ভয়। এর মানে কী! আজ ওর বাসর রাত। বিয়েটা হঠাৎ করেই হয়ে গেল। এর আগে মা বেশ কয়েকটা মেয়ে দেখে কোন না কোন খুঁত খুঁজে বের করেছেন।

এ বিয়েতেও মা গররাজি ছিলেন। জয়ের এককথা, এ বিয়ে না হলে আর বিয়ে করব না। কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়! তাছাড়া এ মেয়েকে দেখতে গিয়ে সব কেমন ওলটপালট হয়ে গেল, চোখের দৃষ্টিতে এমন কিছু একটা ছিল ওর সব কেমন জট পাকিয়ে গেল।
ফুলের তীব্র গন্ধে ওর কেমন দমবন্ধ ভাব হচ্ছে। ফ্যানের রেগুলেটর এক থেকে পাঁচে নিয়ে এল। চরম বিরক্তি নিয়ে গা থেকে আচকানটা খুলল। এসব পরার কোন মানে হয়, নিজেকে কেমন ক্লাউন ক্লাউন মনে হচ্ছিল!

আড়চোখে তাকিয়ে বিস্ময়ের সীমা রইল না। মেয়েটা কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে, ভয়ে মনে হচ্ছে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসবে! এসব কী, ও বাঘ না ভালুক! যথেষ্ট দূরত্ব রেখে খাটে বসে কোমল গলায় বলল, ইভা এমন করছ কেন, কি হয়েছে!
ইভা চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বলল, আপনার পায়ে পড়ি, আমাকে ছোঁবেন না। ইভা সত্যি সত্যি জয়ের পা ধরতে গেল।
জয় বিদ্যুৎগতিতে সরে যেতে গিয়ে মশারীর একটা স্ট্যান্ড ফেলে দিল। মশারীর স্ট্যান্ডটা একপাশে দাঁড় করাতে করাতে ভাবছে , আরে, এ এমন রকম করছে কেন!
জয় সামলে নিয়ে হাসিমুখে বলল, নিষেধ করে তুমিই দেখি আমাকে ছুঁয়ে ফেলছ, শান্ত হও, আমি তোমার গায়ে হাত দেব না। কি বিশ্বাস হচ্ছে না? ইভার গা ভয়ে কাঁপছে। খুব ইচ্ছা করছে কথাগুলো বিশ্বাস করতে- বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলছে?
জয় হাঁই চেপে বলল, তোমার নিশ্চই ঘুম পাচ্ছে, শুয়ে পড়ো। আমার মনে হয় আমি অন্য ঘরে শুলে তুমি আরামে ঘুমাতে পারতে। কিন্তু সেটা ঠিক হবে না, এ নিয়ে ভারী গোলমাল হবে। সবাই তোমাকেই দুষবে। তুমি খাটে শোও, আমি শোফায় শুচ্ছি। প্লিজ আমার উপর বিশ্বাস রাখো। কি রাখা যায় বিশ্বাস?

ইভা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কৃতজ্ঞ চোখে তাকাল। নতুন জীবনের শুরুটা তো ভালই মনে হচ্ছে- সামনে কি আছে কে জানে! সব কথা জানলে এরা কি অনর্থই না করবে! আচ্ছা, তাইলে কি এরা সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলবে?
জয় সোফায় একটা বালিশ আর কোল বালিশ ফেলল। ওর এই একটা বদভ্যাস। কিছু আঁকড়ে না শুলে ঘুম হয় না। সিগারেট ধরিয়ে অপ্রসন্ন হয়ে বলল, সরি, তোমার কথা মনে ছিল না, সিগারেটের ধোঁয়ায় নিশ্চই তোমার সমস্যা হচ্ছে। ইয়ে, জাস্ট এক টান দিয়ে নিবিয়ে ফেলব, প্রমিজ। মনে মনে ভাবছে, ধ্যাত, নিজের ঘরে আরাম করে সিগারেট টানা না গেলে বেঁচে থেকে সুখ কী!

ইভা হাসি গোপন করে শংকিত চোখে তাকিয়ে আছে, এর এক টানের নমুনা ভয়াবহ। ভাব দেখে মনে হচ্ছে এক টানে পুরো সিগারেটটা শেষ করে ফেলবে। চোখ কেমন বড়ো হয়ে গেছে! জয় তাড়াহুড়ো করে অ্যাশট্রেতে সিগারেট নিভিয়ে খকখক করে কাশতে লাগল। অসতর্কতায় পানি খেতে গিয়ে টেবিলের কিনারায় রাখা কাঁচের জগ ফেলে দিয়েছে। কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ সুনসান রাতে কানে তালা লাগার উপক্রম। ইভার কেমন মায়া হচ্ছে, আহা, বেচারা ধীরে-সুস্থে শেষ করলে কি হত। ও তো আর নিষেধ করেনি।

মা দমাদম দরজা পেটাচ্ছেন। খোকা-খোকা, কি হইল, দরজা খোল।জয় লাফিয়ে দরজা খোলার চেষ্টায় পায়ে জড়িয়ে গেছে আচকানটা, আচকানসহ পা টেনে টেনে হাঁটতে চেষ্টা করছে- ঘন ঘন পা ঝাঁকিয়ে ছাড়াবার চেষ্টা করছে। একহাতে হেলমেটের মতো ধরে রেখেছে বিয়ের পাগড়ি, অন্য হাতে ছিটকিনি খোলার আপ্রাণ চেষ্টা। অনেক কসরৎ করে অবশেষে আটকে যাওয়া দরজাটা খুলতে পারল। ইভার মজা লাগছে মানুষটা উদ্ভটসব কান্ড দেখে!

জয় বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, তুমিও মা, এমন করে কেউ দরজা পেটায়! জয়ের মা ভেতরে না ঢুকে, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আগুন গলায় বললেন, থাপড়াইয়া কানপট্টি ফাটায়া ফেলব। গোটা ফ্লাটের লোক জেগে গেছে। অপদার্থ, হইছেটা কী! তোর পায়ে এইটা কি, ব্যান্ডেজ! অরি আল্লা, পাও কাটছে!
জয়ের লাজুক ভঙ্গি, কিছু না মা, পানির জগ ভেঙ্গেছে। জয়ের মা হাহাকার করে উঠলেন, কাঁচ দিয়ে পা কেটেছিস?
আরে না মা, তুমিও! আর এইসব কি কথা, আচকানটা তোমার কাছে ব্যান্ডেজ মনে হচ্ছে, আশ্চর্য।

জয়ের মা এইবার কাশি দিয়ে ঘরে ঢুকে চোখে বুলিয়ে ধোঁয়া দেখে আঁচ করে নিলেন। তীব্র কন্ঠে বললেন, এই বান্দর, অন্য একজন মানুষ ঘরে আছে সেই খেয়াল নাই। আবার নতুন জগটাও ভেঙ্গে ফেলেছিস দেখি! জয় বিব্রত হল, সরি মা।
জয়ের মা এইবার ইভার দিকে ফিরে বললেন, ইভা মা, তুমি একটু কানে আঙ্গুল দাও তো। এই বান্দরটার সাথে আমি বান্দরের ভাষায় একটু কথা বলি। না-না, সত্যি সত্যি কানে আঙ্গুল দাও।

ইভা বিভ্রান্ত হয়ে কানে আঙ্গুল দিয়ে মা-ছেলের কান্ডকারখানা দেখছে। আল্লা জানে, সামনের দিনগুলো কেমন যাবে জয়ের মা কাঁচের টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় ইভাকে কোমল গলায় বলে গেলেন, ইভা মা, ওর দিকে একটু খেয়াল রেখ, মাঝেমাঝে ওর শ্বাসকষ্টের মত হয়।
জয়ের মা বেরিয়ে গেলে জয় মাথা নীচু করে হাসল। ইভা, মার কথায় কিছু মনে করো না। দেখবে, তোমার সঙ্গে ভাব হতে সময় লাগবে না।


জয়ের দু-চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। সোফায় লম্বা হলো। কিছুটা সময় চশমা পরেই নাক বরাবর ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল, উসখুস করে চশমা সোফার হাতলে ঝুলিয়ে দিল। ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে ভাবল, এই মেয়েটি তাইলে সারা জীবন এখানে থাকবে। ওর, ওর পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে নেবে! আজন্ম পরিবেশ ছেড়ে সম্পূর্ণ নতুন এ পরিবেশে মানিয়ে চলতে হবে। আগে হয়তো সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমাত। এখন এ পরিবারের সকাল ছ-টায় হলে ওকেও কি ছ-টায় উঠতে হবে?"... 

*পরের পর্ব: http://www.ali-mahmed.com/2010/08/blog-post_17.html